জেরুজালেমের ইতিহাস

জেরুজালেমের ইতিহাস।

পবিত্র কুরআনের একটি আয়াতকে ঢালস্বরুপ ব্যাবহার করে অমুসলিমরা দাবি করতে চাই যে,পবিত্র ভূমি জেরুজালেমের প্রকৃত মালিক ইহুদি জাতি। কেননা আল্লাহ তাদের এই ভূমি দিয়েছে। সুতরাং জেরুজালে ইহুদিদের।

হে আমার সম্প্রদায়! এই পুণ্য ভূমিতে প্রবেশ কর যা আল্লাহ তোমাদের জন্য লিখে দিয়েছেন, আর পিছনের দিকে ফিরে যেওনা, তাহলে তোমরা সম্পূর্ণ রূপে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। [1]সূরা মায়েদা; ৫ঃ২১

জেরুজালেম

জেরুজালেম এশিয়া মহাদেশের মধ্যপ্রাচ্যো ভূমধ্যসাগর ও মৃত সাগর এর মর্ধ্যবর্তী যোধাইয়ন পর্বতের মালভূমিতে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় নগরী। জেরুজালেম ইহুদী ধর্ম, খ্রিস্টান ধর্ম এবং ইসলাম ধর্মের পবিত্র স্থান।

জেরুজালেম কি ইহুদিদের? বা জেরুজালেম কি ইসরায়েলেরই?

এই ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই যে আল্লাহ বনি ইসরাইল জাতিকে পবিত্র ভূমি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। হিব্রু বাইবেল এবং ইসলামী ধর্মীয় ইতিহাস মোতাবেক, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তালা হযরত ইব্রাহিম (আঃ)কে প্রতিশ্রুতি দেন যে পবিত্র ভূমি কেনান (বর্তমান জেরুজালেম) তার সন্তানাদের দেওয়া হবে। অর্থাৎ তার বংশধররা এই ভূমির মালিক হবে। [2]সূরা মায়েদা; ৫ঃ২১ [3]গণনা পুস্তক; ১৩ঃ২

কিন্তু অমুসলিম ও খ্রিস্টান মিশনারিরা একটা জিনিস এড়িয়ে যাই তা হচ্ছে “ভূমি শর্ত সাপেক্ষে দেওয়া হয়েছে।” তারা কৌশলে শর্তের বিষয় এড়িয়ে যায়। অর্থাৎ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তালা ইহুদি জাতিকে ভূমি দিয়েছে সাথে ভূমিতে থাকার জন্য কিছু শর্ত দিয়েছে। ইহুদি জাতি সেই শর্ত মোতাবেক চলতে ব্যার্থ হয়েছে তাই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তালা ইহুদিদের সেই ভূমি থেকে বের করে দিয়েছে।  

কি সেই শর্ত ? 

এর আগে (মূসাকে) বাণী দেয়ার পর আমি যুবূরে লিখে দিয়েছিলাম যে, আমার সৎকর্মপরায়ণ বান্দাহ্গণই পৃথিবীর উত্তরাধিকার লাভ করবে। [4]সুরা আম্বিয়া; ২১ঃ১০৫

কিন্তু নম্র ভদ্র লোকেরা দেশের দখল পাবে, প্রচুর দোয়া পেয়ে তারা আনন্দে মাতবে। [5]যাবুর-৩৭ঃ১১

আল্লাহ ভক্ত লোকেরা দেশের দখল পাবে, আর সেখানে চিরকাল বাস করবে। [6]যাবুর-৩৭ঃ২৯

কে সেই লোক যে মাবুদ কে ভয় করে? কোন পথ তাকে বেচে নিতে হবে তা তিনি দেখিয়ে দিবেন। সে উন্নতির মধ্যে তার জীবন কাটবে, আর তার বংশধরেরা দেশের অধিকার পাবে। [7]যাবুর-২৫ঃ১২-১৩

আজ তোমাদের যে সকল আদেশ করছি, তোমরা যদি প্রভু, তোমাদের ঈশ্বরের, সেই সব আজ্ঞা যত্নের সাথে পালন করো তবে প্রভু তোমার ঈশ্বর পৃথিবীর সমস্ত জাতির উপর তোমাদের উন্নত করবেন। যদি তোমরা প্রভু, তোমাদের ঈশ্বরের, বাধ্য হও তবে এইসব আশীর্বাদ তোমাদের উপরে আসবে। [8]দ্বিতীয় বিবরণ; ২৮ঃ১-২

কিন্তু প্রভু, তোমাদের ঈশ্বরের, কথা না শুনো , তিনি যা আদেশ করেছেন আমার আজকের বলা সেই সব আদেশ যত্ন সহকারে পালন না করো তবে এই সমস্ত অভিশাপ তোমাদের উপর বর্তাবে। [9]দ্বিতীয় বিবরণ; ২৮ঃ১৫

কুরআন ও যাবুরে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তালা ইহুদিদের পবিত্র ভূমি বা জেরুজালেমে থাকার জন্য বেশ কিছু শর্ত আরোপ করেছে। যেমন, এই ভূমিতে থাকতে হলে তাদেরকে নম্র ভদ্র হতে হবে, তাদেরকে আল্লাহ ভক্ত হতে হবে, প্রভুর আদেশ মান্য করতে হবে, সৎকর্মপরায়ণ হতে হবে। এবং তারা যদি এই শর্ত অমান্য করে তাহলে তাদেরকে অভিশাপ দেওয়া হবে। তাদের কে এই ভূমি থেকে বিতাড়িত করা হবে। তাদের উপর কঠিন আজাব দেওয়া হবে।

ইহুদিরা কি আল্লাহর দেওয়া শর্তগুলো রক্ষ্যা করতে পেরেছিল ? 

না! বরং ইহুদিরা গর্ব অহংকারে ফুলে উঠেছিল। তারা আল্লাহর কিতাব বিকৃত করেছিল! তারা অসংখ্য নবী রাসুলদের হত্যা করেছিল। সুতরাং এখন তাদের সেই ভূমিতে থাকার অধিকার নেই। আল্লাহর দেওয়া শর্ত অমান্য করার কারণে, আল্লহ সুবহানাহু ওয়া তালা তাদের পবিত্র ভূমি থেকে বিতাড়িত করেছেন। তাদের অভিশাপ দিয়েছে।

কোরআনের বর্ণনা,

আমি কিতাবের মাধ্যমে বানী ইসরাঈলকে জানিয়ে দিয়েছিলাম যে, তোমরা অবশ্য অবশ্যই পৃথিবীর বুকে দু’ দু’বার বিপর্যয় সৃষ্টি করবে আর অবশ্য অবশ্যই অত্যধিক গর্বে ফুলে উঠবে। অতঃপর যখন দু’টির মধ্যে প্রথমটির সময় এসে উপস্থিত হল, তখন আমি তোমাদের বিরুদ্ধে পাঠিয়ে দিলাম আমার বান্দাদেরকে যারা ছিল যুদ্ধে অতি শক্তিশালী, তারা (তোমাদের) ঘরের কোণায় কোণায় ঢুকে পড়ল, আর সতর্কবাণী পূর্ণ হল। [10]সূরা বনি ইসরাইল আয়াত ৪-৫

বাইবেলের বর্ণনা

প্রভু তোমাদের শত্রুদের দিয়ে তোমাদের হারাবেন| তোমরা এক পথ দিয়ে তোমাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যাবে কিন্তু সাত পথ দিয়ে তাদের সামনে থেকে পালাবে| তোমাদের প্রতি যে সব খারাপ বিষয় ঘটবে তা দেখে পৃথিবীর লোক ভয় পাবে। [11]দ্বিতীয় বিবরণ-২৮ঃ২৫

প্রভু মিশরীয়দের কাছে যেমন ফোড়া পাঠিয়েছিলেন সেই রকমটি দিয়েই তোমাদের শাস্তি দেবেন। তিনি আর, গলিত ঘা এবং সারে না এমন চুলকানি দিয়ে তোমাদের শাস্তি দেবেন। প্রভু উন্মাদনা দ্বারা তোমাদের শাস্তি দেবেন। তিনি তোমাদের অন্ধ এবং হতবুদ্ধি করবেন। [12]দ্বিতীয় বিবরণ- ২৮ঃ২৮

তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য প্রভু বহুদূর থেকে এক জাতির আগমন ঘটাবেন| তোমরা তাদের ভাষা বুঝবে না| ঈগল পাখি যেমন আকাশ থেকে নেমে আসে তেমনি দ্রুত তারা আসবে। [13]দ্বিতীয় বিবরণ- ২৮ঃ৪৯

দ্বিতীয় বিবরণ ২৮ অধ্যায়ে আরো অসংখ্য প্রমান রয়েছে। লেখাটি লম্বা হয়ে যাবে তাই সবগুলো দেওয়া সম্ভব নয়। আল্লাহ্‌ তায়ালা বনী ইসরাইলিদেরকে সতর্ক করেছিলেন তাদের দুইবার ফ্যাসাদ সৃষ্টির বিষয়ে এবং দুইবারই তাদেরকে চরম শাস্তি দিয়ে আল্লাহ্‌ তাঁর কথা রাখেন।

প্রথম ঘটনাটি

সুলাইমান বা সলোমনের মারা যাবার পর পুত্র রেহোবামের রাজত্বকালে ইজরায়েলের পতন শুরু হয়, ইসরাইল দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। তখন ইহুদি আলেমরা তাওরাতের আংশিক পরিবর্তন করতে থাকে। যার ফলে তারা পবিত্র ভূমিতে থাকার অধিকার ও তাদের ইমান হারিয়ে ফেলে। যার ফলে আল্লাহ কর্তৃক তাদেরকে পবিত্র ভুমি থেকে বিতাড়িত করে। খ্রিস্টপূর্ব ৫৮৭ সনে, যখন বখতে-নসরের (Nebuchadnezzar) নেতৃত্বে ব্যাবীলনীয় এক বাহিনী জেরুজালেম অবরোধ করে, তারপর শহরটি পুড়িয়ে দেয়, এর অধিবাসীদের হত্যা করে, সুলাইমান (আ) কর্তৃক তৈরি করা মসজিদ ধ্বংস করে দেয় এবং ইহুদি জনসংখ্যার উৎকৃষ্ট ও গুরুত্বপূর্ণ অংশকে ক্রীতদাস হিসেবে ব্যাবীলনে নিয়ে যায়। 

দ্বিতীয় ঘটনাটি

এরপর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তালা তাদের উপর আরেকজন নবী পাঠালেন যাতে করে তাদের কাছে এক ঐশ্বরিক অঙ্গীকার সম্পর্কে অভিত করা হয়। ঐশ্বরিক অঙ্গীকার টা হচ্ছে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তালা তাদের কাছে এমন একজন নবি পাঠাবেন যিনি দাউদ (আঃ) এর সিংহাসনে বসে পুরো পৃথিবীকে শাসন করবে। [14]বুক অব আইজাইয়া, অরধ্যায় ৯-আয়াত ৬-৭  

তিনি হচ্ছেন ঈসা (আঃ)। তবে যখন তাদের এই ঐশ্বরিক অঙ্গীকার সম্পর্কে অভহিত করা হয় তখন তারা ছিল ব্যাবলিনে ক্রিতদাস হিসেবে। কিছুদিন পর পবিত্র ভূমি স্বাধীন করা হয় ।

রাজা সাইরাস ব্যাবলিয়ানদের সাথে যুদ্ধ করে বনি ইস্রাইলদের মুক্ত করে পবিত্র ভূমিতে যাওয়ার অনুমতি দেই। ইহুদিরা অপেক্ষা করতে থাকে যে মাসিহ বা ঈসা (আঃ) কখন আসবেন। কিন্তু যখন মসীহ বা ঈসা (আঃ) আসলেন তখন খুব অল্প সংখ্যক ইহুদি তার উপর ইমান এনেছিল। যখন যীশু ইহুদী ইমামদের (র‍্যাবাইদের) দুর্নীতি নিয়ে কথা বলতে লাগলেন তখন ইহদিরা চক্রান্ত করল যেন রোমান শাসককে বুঝিয়ে যীশুকে ক্রুশে দিয়ে মেরে ফেলা যায়, এবং তাই তারা করে।

ইহুদীদের মতে তারা যীশুকে ক্রুশে দিয়ে মেরে ফেলে। যদিও ইসলাম ধর্ম মতে, আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তালা হযরত ঈসা (আঃ)-কে অক্ষত রাখেন এবং তুলে নেন, যিনি শেষ সময়ে আবার ফিরে আসবেন। ঈসা (আঃ) কে ক্রুশবিদ্ধ করার পর যখন ইহুদিরা গর্ব করলো এবং তাঁকে হত্যার ক্রেডিট নিয়ে উল্লাসে ফেটে পড়লো তখন আবার তাদেরকে শাস্তির মুখোমুখি করা হয়। 

সেনাপতি টাইটাসের (Titus) এর নেতৃত্বে রোমান বাহিনী ৭০ খ্রিস্টাব্দে জেরুজালেম অবরোধ করে। টাইটাস জেরুজালেম শহর ধ্বংস করে দেয়, এর বাসিন্দাদের হত্যা করে ও পবিত্রভূমি থেকে অবশিষ্ট ইহুদিদের বহিষ্কার করে। পবিত্র মসজিদ আল আক্‌সা আবার ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং রোমান সৈন্যরা সেটাকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে, গলিত স্বর্ণ পিন্ডের খোঁজে প্রতিটি পাথরকে এক এক করে আলগা করা হয়, ঠিক যেমনটি ঈসা (আ) সতর্কবাণী দিয়েছিলেন।

দ্বিতীয়বার শাস্তি পাওয়ার পর অর্থাৎ ৭০ খ্রিস্টাব্দে বনী ইসরাইলের উপর জেরুজালেম শহর হারাম হয়ে যায় এবং তারা সারা বিশ্বে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।

আর আমি তাদেরকে (অর্থাৎ ইহুদিদের) বিভক্ত করে দিয়েছি দেশময় বিভিন্ন শ্রেণীতে। [15]সুরা আরাফ ৭:১৬৮

যে সব জনপদকে আমি ধ্বংস করেছি তার অধিবাসীদের ফিরে না আসা অবধারিত – যে পর্যন্ত না ইয়াজুজ ও মা’জুজকে বন্ধনমুক্ত করে দেয়া হবে এবং তারা প্রত্যক উঁচু ভূমি থেকে দ্রুত ছুটে আসবে। [16]সুরা আম্বিয়া আয়াত ২১

সুতরাং , যারা বলে জেরুজালেম ইহুদিদের বা আল্লাহ তাদের এই ভূমি দিয়েছে তারা হয় না জেনে বলে, না হয় উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে এমন মিথ্যা প্রচার করে।

পবিত্র কুরআন ও বাইবেল থেকেই স্পষ্ট যে আল্লাহ নম্র, ভদ্র, আল্লাহ ভিরু, সৎকর্মপরায়ণ লোকদের এই ভূমি দান করেছে। যারা আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে, আল্লাহর কিতাব অমান্য করে, নবী, রাসুলদের হত্যা করে , কিতাব বিকৃতি করে তারা কি সৎকর্মপরায়ণ ? তারা কি আল্লাহ ভিরু ? তারা কি নম্র ভদ্র ?

অবশ্যই তারা সৎকর্মপরায়ণ নয়! আল্লাহ ভিরু নয় ! নম্র ভদ্র নয় ! আল্লাহ তাদের এই ভূমি দিয়েছে শর্ত সাপেক্ষ্যে। তারা সেই শর্ত মেনে চলতে পারেনি ,তাই তাদের সেই ভূমি থেকে আল্লাহ বিতাড়িত করা হয়েছে। এবং তাদের জন্য সেই ভূমি নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এতএব, জেরুজালেমের মালিক কে? এই প্রশ্নের উত্তর একটাই আর তা হলো, জেরুজালেম মুসলিমদের।

Home – Faith and Theology (faith-and-theology.com)

References

References
1, 2 সূরা মায়েদা; ৫ঃ২১
3 গণনা পুস্তক; ১৩ঃ২
4 সুরা আম্বিয়া; ২১ঃ১০৫
5 যাবুর-৩৭ঃ১১
6 যাবুর-৩৭ঃ২৯
7 যাবুর-২৫ঃ১২-১৩
8 দ্বিতীয় বিবরণ; ২৮ঃ১-২
9 দ্বিতীয় বিবরণ; ২৮ঃ১৫
10 সূরা বনি ইসরাইল আয়াত ৪-৫
11 দ্বিতীয় বিবরণ-২৮ঃ২৫
12 দ্বিতীয় বিবরণ- ২৮ঃ২৮
13 দ্বিতীয় বিবরণ- ২৮ঃ৪৯
14 বুক অব আইজাইয়া, অরধ্যায় ৯-আয়াত ৬-৭
15 সুরা আরাফ ৭:১৬৮
16 সুরা আম্বিয়া আয়াত ২১

Sazzatul Mowla Shanto

As-salamu alaykum. I'm Sazzatul mowla Shanto. Try to learn and write about theology and philosophy.

2 Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button