নাস্তিকতা কি স্বভাবজাত ?
নাস্তিকতা কি স্বভাবজাত ?
মুক্তমণা নাস্তিকদের প্রায়ই দাবি করতে দেখা যায় যে, মানুষের ধর্ম, সৃষ্টিকর্তার বিশ্বাস এগুলোর উৎস পরিবার,সমাজ, রাষ্ট্র, সভ্যতা ইত্যাদি। সৃষ্টিকর্তার বিশ্বাস, ধর্মীয় বিশ্বাস, এগুলো সহজাতভাবে উঠে আসেনা। বরং পরিবার, সমাজ রাষ্ট্র তাকে যে বিশ্বাস লালন করতে শিখিয়ে দেয় সে তাই করে। এবং মানুষ সে বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে, পবিত্র বলে মনে করে। সুতরাং ধর্ম , সৃষ্টিকর্তা, বলতে আসলে কিছুই নেই। তাদের এহেন দাবির কারণ, যদি মানুষের মনে অতি প্রাকৃতিক ভাবে কোনো বিশ্বাস থেকে থাকে তাহলে একজন অতি-প্রাকৃতিক সত্তার অস্তিত্বের প্রমাণ হয়ে যায়। যেহেতু নাস্তিকতা বলতে এমন কিছুকে বুঝানো হয়, যেখানে সৃষ্টিকর্তা বা অতি-প্রাকৃতিক সত্তা বলতে কিছুই থাকতে পারেনা। সেহেতু যদি অতি-প্রাকৃতিক সত্তার অস্তিত্বের প্রমাণ হয়ে যায় তাহলে নাস্তিক্যবাদ অচল হয়ে পরবে।
সহজাত বিশ্বাস
সহজাত বিশ্বাস বা স্বভাবজাত বিশ্বাস বলতে বুঝায়, মানুষের ভেতরে জন্মগত ধারণা। অর্থাৎ এ ধরণের বিশ্বাসগুলো কেউ আমাদের শিখিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন হয়না। বরং, যা হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত চিন্তাভাবনা এবং বোধবিবেচনা থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বুঝে নেওয়া। এক কথায়, জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে শেখা নয় যে জ্ঞান তাই সহজাত জ্ঞান বা সহজাত ধারণা। যা কিছু আমরা স্বাভাবিকভাবেই স্বতঃসিদ্ধ সত্য বলে মনে করি। উদাহারণ হিসেবে আমরা বলতে পারি আমাদের এই বহির্জগতের অস্তিত্ব।
যে জীবনকে আমরা বাস্তব মনে করে দিনানিপাত করি, ধুলো ধূসর ইট পাথরের এই যান্ত্রিক শহরে বা সাদামাটা সহজ-সরল নিখাদ গ্রমীণ জীবনে রচনা করি কতশত গল্প-কাব্য; সে জীবন কি স্রেফ কোন স্বপ্ন? নাকি আসলেই এর বাস্তব কোনো অস্তিত্ব আছে? প্রশ্নটি হয়তো খুব শ্রুতিকটু শোনাবে। কিন্তু আপনি কি নিশ্চিত আপনার এই জীবন স্বপ্নের মতো কোনো ব্যাপার নয়? যদি প্রশ্ন করা হয়, আপনার অস্তিত্বের প্রমাণ কি? দর্শন সম্পর্কে যাদের টুকটাক পড়াশোনাও রয়েছে তারা হয়তো চট করে বলে উঠবে, এর উত্তর দার্শনিক রেনে ডেকার্ট অনেক আগেই দিয়েছে। ডেকার্টের সেই বিখ্যাত উক্তি, “I think, therefor I am” অর্থাৎ, “আমি চিন্তা করি, সুতরাং আমি আছি।”
দার্শনিক ডেকার্টের দার্শনিক পদ্ধতি ছিলো সংশয় পদ্ধতি। তিনি সার্বজনীন সত্য জ্ঞান আবিষ্কার করার জন্য সবকিছুকে সংশয় করা শুরু করেন। কিন্তু একটা সময় ডেকার্ট লক্ষ্য করেন যে, আমি যে সংশয় করি, এই সংশয় করার জন্যই তো আমাকে অস্তিত্বশীল হতে হচ্ছে। যদি আমার অস্তিত্ব না থাকে তাহলে চিন্তা করে কে? এভাবে ডেকার্ট তার নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করেন। কিন্ত ডেকার্টের এই কথার নিশ্চয়তা কি? কেউ যদি আপত্তি করে বলে থাকে, এমনও তো হতে পারে; আপনি কেবল দূরের কোনো অজানা গ্রহের একটি পাত্রের মধ্যে ভেসে বেড়ানো নিছক এক মস্তিষ্ক। আর তাতে কলনাঠি নাড়িয়ে আপনার হৃদিয়ে অনুভূতির সৃষ্টি করছে কোনো এলিয়েন। আপনি কি নিশ্চিত, আপনি দূর অজানা কোনো গ্রহের জারে ভেসে থাকা কোনো মস্তিস্ক নন?
নিশ্চিতভাবে এই প্রশ্নের জবাব দেওয়া কখনোই সম্ভব নয়। বরং আমাদের এই মহাজগত যে বাস্ততবে অস্তিত্বশীল এহেন বিশ্বাসকে আমরা স্বতঃসিদ্ধ মনে করি। স্বতঃসিদ্ধ মানে, যা কিছু নিজেই নিজের প্রমাণ। এ ধরনের বিশ্বাসের জন্য আমরা কোনো যুক্তি খুঁজতে যায়না। কোনো প্রকার প্রমাণ ছাড়াই আমরা এগুলো বিশ্বাস করি। দর্শনের ভাষায় এ ধরণের বিশ্বাসগুলোকে Self-evident truth বলা হয়।
নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের আলোচিত দার্শনিক(নাস্তিক) প্রফেসর ডেভিড শালমার্স বলেন,
“আমাদের এই বিশ্বজগৎ যে প্রকৃতই অস্তিত্বশীল তার পক্ষে আপনি কোনো প্রমাণ খুঁজে পাবেন না। কারণ আমরা যে প্রমাণই পাই না কেন, সেটাও অবস্তাব হতে পারে”। [1]https://www.scientificamerican.com/article/are-we-living-in-a-computer-simulation/
স্রষ্টার অস্তিত্ব, বহির্জগতের অস্তিত্ব, আমাদের চিন্তাজগতের অস্তিত্ব, আমাদের যুক্তির বৈধতা, এই বিষয়গুলোও স্বতঃসিদ্ধ আধুনিক দর্শনের জনক রেনে ডেকার্টের এর মতে সকল জ্ঞানই এ সমস্ত ধারণা থেকে গাণিতিক অবরোহ (Through Mathematical Deduction) পদ্ধতিতে লাভ করা যায়। এবং এই ধারণাগুলো স্বতঃসিদ্ধ। [2]দর্শনের সমস্যাবলি; পৃষ্ঠা নং- ৫৭
ডেকার্ট বলেন, আমাদের অভিজ্ঞাতা থেকে প্রাপ্ত যে কোনো জ্ঞানকেই সন্দেহ করা যায়। যেমন, পাতাটি “সবুজ” না বলে যদি আমরা বলি পাতাটি “লাল” তাহলে এখানে চিন্তার মধ্যে কোনো বিরোধিতা দেখা যায়না। আবার “ঘোড়ার ডিম”, “চাঁদের বুড়ি” ইত্যাদি বললে চিন্তার মধ্যে বিরোধিতা দেখা যায়। কিন্তু “২+২=৪”, “ত্রিভূজের তিন কোণের সমষ্টি দু’সমকোণ” এসব ধারণার বিপরীত ভাবাই যায় না। এই জ্ঞানগুলো অভিজ্ঞতালব্ধ নয়, সহজাত। এছাড়াও, অভিজ্ঞতায় অর্জিত জ্ঞানকে সন্দেহ করা যায় বা মতানৈক্য দেখা যায়। কেননা, অভিজ্ঞতায় অর্জন করা জ্ঞান একেক ব্যাক্তির কাছে একেক রকম। স্থান কাল পরিবর্তনের সাথে এই জ্ঞানের পরিবর্তন হয়। কিন্তু এমন কিছু “চিন্তার মৌলিক নিয়ম” (Fundamental Laws of Thought) আমাদের মধ্যে রয়েছে যেগুলো অভিজ্ঞতালব্ধ নয় বরং অভিজ্ঞতাপূর্ব (Apriori)।
সহজাত ধারণা সম্পর্কে ডেকার্ট বলেন,
“সহজাত ধারণা অনিবার্য। কারণ, সহজাত ধারণা ব্যাতীত মানুষের জ্ঞানজগৎ অকল্পনীয় হয়ে পড়ে।” [3]সরদার ফজুলল করিম, দর্শনকোষ, ২২৪-২২৫ পৃষ্ঠা
কেউ যদি স্বতঃসিদ্ধ বিষয়গুলো অস্বীকার করে তখন যুক্তি প্রবণ মানুষ হিসেবে আপনার তাকে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়া উচিত যে এই বিষয়গুলো অস্বীকার করার জন্য তোমার কাছে কী প্রমাণ আছে? যেমন, কেউ যদি দাবি করে, আমাদের এই মহাবিশ্বের বাস্তব কোনো অস্তিত্ব নেই, যা আছে তা স্রেফ স্বপ্ন, তোমার আসলে বাস্তব কোনো অস্তিত্ব নেই, এগুলো সবই মস্তিষ্কের বিভ্রম। এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে আপনি কি, আপনার অস্তিত্ব, মহাবিশ্বের অস্তিত্বকে বাস্তব প্রমাণ করার চেষ্টা করবেন নাকি তাকে পালটা প্রশ্ন ছুড়ে দিবেন যে, এগুলো যে অস্তিত্বে নেই এমন দাবীর পক্ষে তোমার কাছে কী প্রমাণ আছে?
একজন যুক্তিপ্রবণ মানুষ হিসেবে অবশ্যই তাকে পালটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়া উচিত। কারণ, আমাদের অস্তিত্ব, এই মহাবিশ্বের অস্তিত্বকে আমরা স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে বিবেচনা করি। সুতরাং, যেকোনো স্বতঃসিদ্ধ সত্যের সত্যতা নিয়ে কেউ চ্যালেঞ্জ করলে তা প্রমাণ করার দায় চ্যালেঞ্জকারীর উপর।
স্রষ্ট্রা: স্বতঃসিদ্ধ সত্য
নাস্তিকদের দাবি কতটুকু যৌক্তিক? আসলেই কি ধর্ম, সৃষ্টিকর্তার বিশ্বাস আমাদের সমাজ,পরিবার, আমাদের উপর চাপিয়ে দেয় ? আর আমরা তা অন্ধভাবে মেনে নেই ? যদি সত্যি তাই হয় তাহলে নাস্তিকতাই তো ঢের যৌক্তিক ! কিন্তু সত্য এটাই যে নাস্তিকতা স্বভাবজাত কিছু নয় বরং ধর্ম, সৃষ্টিকর্তা,এগুলোই হচ্ছে স্বভাবজাত। এবং এই সহজাত বিশ্বাস দিয়েই নাস্তিক্যবাদকে ধুমরে মুচরে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলা দেওয়া যায়।
একদল শিশুকে কোনো এক জনমানবহীন, শহর থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো একটি দ্বীপে রেখে আসা হলো। সেখানে তারা নিজেরাই বেড়ে উঠতে লাগলো। সেখানে তারা কি এই বিশ্বাস নিয়ে বেড়ে উঠবে যে জগত অস্তিত্বে আসার জন্য একজন সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব রয়েছে ? নাকি এমন বিশ্বাস নিয়ে বেড়ে উঠবে যে এই জগতের অস্তিত্বের জন্য কোনো অতিপ্রাকৃতিক সত্তা বা সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব নেই? একজন নাস্তিক হয়তো খুব সহজেই উত্তর দিবে হ্যাঁ অবশ্যই সে এমন বিশ্বাস নিয়ে জন্ম নিবে যে, জগৎ অস্তিত্বে আসার জন্য কোনো অতিপ্রাকৃতিক সত্তা বা সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব নেই। কিন্তু কগনিটিভ সাইন্টিস্ট ও গবেষকগণ ভিন্ন সুরে কথা বলে।গবেষকদের দাবি অনুযায়ী শিশুরা স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাসের পূর্বধারণা নিয়েই জন্মগ্রহন করে। অর্থাৎ শিশুরা প্রাকৃতিক ভাবেই সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব নিয়ে জন্মায়। তাই ধর্ম, সৃষ্টিকর্তার বিশ্বাস এগুলো পরিবার,সমাজ,রাষ্ট্র আমাদের উপর চাপিয়ে দেয় আর আমরা তা অন্ধভাবে আঁকড়ে ধরি নাস্তিকদের এহেন দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।
University of Oxford এর Centre for Anthropology and mind বিভাগের সিনিয়র রিসার্চার Dr. Justin barrott দীর্ঘ ১০ বছর শিশুদের উপর বৈজ্ঞানিক গবেষণা করে বলেছেন,
Human beings are natural believers in God.” অর্থাৎ, মানুষ স্বভাবতই ঈশ্বরে বিশ্বাসী। [4]Children are born believers in God, academic claims [5]ARE WE BORN BELIEVERS?
এছাড়া তিনি BBC Radio তে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেনঃ
“আপনি যদি কিছু সংখ্যক শিশুকে কোনো দ্বীপে রেখে আসেন আর তারা নিজেরাই বেড়ে উঠে, আমি মনে করি তারা স্রষ্টায় বিশ্বাস করবে। [6]প্রাগুক্ত
Dr. Justin barrott এই বিষয়ের ওপর বইও লিখেছেন; Born Believers: The Science of Children’s Religious Belief শিরোনামে। [7]Born Believers: The Science of Children’s Religious Belief
সমাজবিজ্ঞানি ও নিবিজ্ঞানীদের মতে,
যদি নাস্তিকদের শিশু সন্তানদের কোনো মরুদ্বীপে ফেলে রাখা হয়,তাদের মনে একসময় এই বিশ্বাস জাগবে; কেউ না কেউ এই দ্বীপ তৌরি করেছে। [8]BBC Today; Are we born believing in God?
একইভাবে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানি Dr. Olivera petrovich পিয়ার রিভিউ জার্নালে তার গবেষণার ফলাফল জানান,
কিছু ধর্মীয় বিশ্বাস যে সার্বজনীন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে (যেমন, কোনো বিমূর্ত সত্তাকে বিশ্বজগতের স্রষ্টা হিসেবে মৌলিক বিশ্বাস), এর পক্ষে শক্তিশালী প্রমাণ ধর্মগ্রন্থের বাণীর চেয়ে বরং বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকেই বেশি বেরিয়ে আসছে বলে প্রতিয়মান হচ্ছে।” [9] Key psychological issues in the study of religion
এছাড়া, অস্ট্রেলিয়ান একটি নিউজ জার্নালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়,
Dr. Olivera petrovich বলেন, “belief in God is not taught but develops naturally” অর্থাৎ, ঈশ্বরে বিশ্বাস শেখানো হয় না কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই বিকশিত হয়। Dr. Olivera petrovich সাইকোলজি অব রিলিজিয়নের উপর বিশেষজ্ঞ এবং তিনি একজন নাস্তিক। [10]Infants ‘have natural belief in God’
প্রফেসর রবার্ট ম্যাকাওলি, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে তার প্রকাশিত তার, Why Religion is Natural and Science is not’ গ্রন্থে Dr. Olivera petrovich এর সুরে কথা বলেছেন। [11]Robert N.McCauley, Why Religion is Natural and science is not. page;221
ইয়েল ইউনিভার্সিটির গবেষক পল ব্লুম জার্নাল অব ডেভলোপমেন্টাল সাইন্স-এ প্রকাশিত এক পেপারে জানান,
বিগত বছরগুলোতে পরিচালিত কিছু বৈজ্ঞানিক গবেষণা জানাচ্ছে কিছু সার্বজনীন ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়েই শিশুরা জন্মায়, যেমন; ঐশ্বরিক সত্তার অস্তিত্ব, মহাবিশ্বের ঐশ্বরিক সৃর্ষ্টি, মনের অস্তিত্ব, পরকালের বিশ্বাস ইত্যাদি। [12]Paul bloom religion is natural journal of developmental science 10:1 p 147-151
বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের (নাস্তিক) গবেষক ডেবোরাহ কেলেমেন “শিশুরা কি সহজাতভাবে আস্তিক ?” এই শিরোনামে একটি প্রবন্ধ বের করেছেন। এবং সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন যে,
সম্প্রতি মননগত গবেষণায় দেখা যায় যে, ৫ বছরের দিকে শিশুরা বুঝতে শুরু করে প্রাকৃতিক বস্তু গুলো মানব সৃষ্ট নয়। ৬-১০ বছর বয়সী শিশুরা প্রকৃতির মাঝে একটা মহৎ উদ্দেশ্য খুঁজে পায়। এসব গবেষণা থেকে শিশুদের ব্যাক্ষ্যামূলক মনোভাবকে সহজাত আস্তিক্যবাদ হিসেবে বলা যেতে পারে। [13]Are Children ‘‘Intuitive Theists’’? Reasoning About Purpose and Design in Nature.
এছাড়াও ডেভবোরাহ কেলেমেন বিভিন্ন গবেষণার ফলাফল থেকে সিদ্ধান্ত জানান যে,
অতিপ্রাকৃতিক সত্তায় ধর্মীয় বিশ্বাস বাহ্যিক, সামাজিক উৎস থেকে নয় বরং, প্রাথমিকভাবে মানুষের ভেতর থেকেই উৎপত্তি হয়। এ বিশ্বাস মানব মনের মৌলিক উপকরণ। [14]Patrick Mcnamara Ph.D, Wesley J. Wildman (etd.), Science and the World’s Re-ligions; vol. 02 (persons and Groups), p.206,209 (Publisher ABC-CLIO, July 19,2012)
এলিনা জার্নেফেল্ট, কেটলিন এফ.ক্যানফিল্ড এবং ডোবোরাহ কেলেমেন সাম্প্রতি একটি গবেষণা করেছে “অবিশ্বাসীদের বিভক্ত চিন্তাধারা; বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর নিধার্মিক প্রাপ্ত বয়স্কদের মাঝে প্রকৃতির উদ্দেশ্যমূলক সৃষ্টির ব্যাপারে সহজ বিশ্বাস” এই শিরোনামে। এই গবেষণার থেকে জানা যায়, প্রকৃতিকে পরিকল্পিত হিসেবেই দেখার একটা স্বাভাবিক প্রবণতা রয়েছে মানুষের। গবেষণার ফলাফলটি দেওয়া হয় তিনটি সমিক্ষার মাধ্যমে।
প্রথম সমিক্ষাটি করা হয় ৩৫২ জন প্রাপ্ত বয়স্ক উত্তর-আমেরিকানদের ওপর। দ্বিতীয় সমীক্ষাটি করা হয় ১৪৮ জন উত্তর আমেরিকানদের উপর। এবং তৃতীয় সমীক্ষাটি করা হয় ১৫১ জন ফিনল্যান্ডের বসবাসরত মানুষের মধ্যে।
সমীক্ষায় ধার্মিক এবং অধার্মিক দু-ধরণের লোকই অংশগ্রহণ করেছিলো। তাদেরকে কম্পিউটারের মাধ্যমে ১২০টি ছবি দেখানো হয়ছিল। এবং তাদের কাজ ছিলো, “ ছবিতে যা দেখা যাচ্ছে তা কেউ উদ্দেশ্যমূলকভাবে সৃষ্টি করেছে কিনা তা নির্ধারণ করা।” তাদের কাউকে কাউকে ঝটপট উত্তর দিতে বলা হয়েছিল এবং কাউকে কাউকে কিছুক্ষণ ভাবার সময় দেওয়া হয়েছিল। কিবোর্ডের মাধ্যমে হ্যা অথনা না ফলাফল দিতে হতো তাদের।
প্রত্যেকটি সমীক্ষা থেকেই প্রাপ্ত ফলাফল এই যে, “নাস্তিকেরাও সৃষ্টির মধ্যে একটা উদ্দেশ্য খুঁজে পায়।”
এই গবেষণা থেকে প্রমাণিত হয়, প্রকৃতিকে পরিকল্পিত হিসেবে দেখার একটা সহজাত প্রবণতা বা জন্মগত বিশ্বাস আমাদের মাঝে রয়েছে। [15]The divided mind of a disbeliever: Intuitive beliefs about nature as purposefully created among different groups of non-religious adults
বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইউজিন নাগাসাওয়া তার বইতে উল্লেখ করেছেন,
সাম্প্রতি কগনেটিভ সাইন্স অব রিলিজিওন ফিল্ডের গবেষণা থেকে জানা যায় যে, মানুষ, বিশেষ করে শিশুরা সহজাতভাবে প্রকৃতিতে প্রকৃতিতে উদ্দেশ্য এবং বুদ্ধিমত্তা দেখতে পায়। সেখানে আরো উল্লেখ করা হয়, মনোবিজ্ঞানি ডোবোরাহ কেলেমেন আমেরিকায় কিছু বিদ্যালয়ের শিশুদের উপর গবেষণা করে জানায় যে শিশুরা সহজাতভাবেই টেলিওলজিক্যাল পরিপ্রেক্ষিতে প্রাকৃতিক বস্তুর সমূকে ব্যাখ্যা করে। [16]The Existence of God: A Philosophical Introduction; Page-57-58
সেক্যুলার গবেষক এন্ড্রু নিউবার্গের মতে,
আমাদের মস্তিষ্ক যেভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে তাতে মানুষের জন্য ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞাতা লাভ খুবই সহজ একটি ব্যাপার, গবেষণার ফল নিঃসন্দেহে সেদিকেই ইঙ্গিত করেছে। [17]Elizabeth king, I’m an atheist. So why can’t I shake God? The washington post, February 4,2016
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির প্রফেসর রজার ট্রিগ এর মতে,
ধর্মকে দমিয়ে রাখার প্রচেষ্টা ক্ষণস্থায়ী কারণ ধর্মবিশ্বাস মানব মনে গ্রথিত বলেই প্রতীয়মান হয়। [18]Tim Ross, Belief in God is part of human nature – Oxford study. The Telegraph,12may2011
নাস্তিক মনোবিজ্ঞানি প্যাসকেল বয়ার Nature জার্নালে প্রকাশিত পেপারে উল্লেখ করেছেন,
নাস্তিকতা হলো আমাদের সহজাত চেতনার(Natural Cognitive disposition) বিরুদ্ধে। [19]Pascal Boyer, Bound to Believe?;Nature,Vol.455,p.1038-1038
ইসলামের দৃষ্টিতে সহজাত বিশ্বাস।
ইসলামের দৃষ্টিতে সহজাত বিশ্বাসের নাম ফিতরা। এই শব্দটি এসেছে ফাতারা থেকে। ধর্মতাত্ত্বিক দিক থেকে ফিতরা হচ্ছে মানুষের স্বাভাবিক বিশ্বাস বা জন্মগত বিশবাস।
আল্লাহ তা’আলা বলেছেন,
কাজেই দ্বীনের প্রতি তোমার মুখমন্ডল নিবদ্ধ কর একনিষ্টভাবে। এটাই আল্লাহ প্রকৃতি, যে প্রকৃতি তিনি মানুষকে দিয়েছেন, আল্লাহর সৃষ্টি কার্যে কোন পরিবর্তন নেই, এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত দ্বীন, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না। [20]সূরা আর-রুম; ৩০ঃ৩০
আর স্মরণ কর, যখন তোমার রব বনী-আদমের পৃষ্ঠদেশ হতে তাদের বংশধরকে বের করলেন এবং তাদেরকে তাদের নিজদের উপর সাক্ষী করলেন যে, ‘আমি কি তোমাদের রব নই’? তারা বলল, ‘হ্যাঁ, আমরা সাক্ষ্য দিলাম।’ যাতে কিয়ামতের দিন তোমরা বলতে না পার যে, নিশ্চয় আমরা এ বিষয়ে অনবহিত ছিলাম। [21]সূরা আরাফ:১৭২
আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত নবি মুহাম্মদ (সাঃ) এর থেকে নির্ভরযোগ্য একটি হাদিস রয়েছে এই ব্যাপারে।
তিনি বলেন, আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ করেছেন; প্রত্যেক নবজাতকই ফিত্রাতের উপর জন্মলাভ করে। অতঃপর তার পিতামাতা তাকে ইয়াহূদী, নাসারা বা মাজূসী (অগ্নিপূজারী) রূপে গড়ে তোলে। যেমন, চতুষ্পদ পশু একটি পূর্নাঙ্গ বাচ্চা জন্ম দেয়। তোমরা কি তাকে কোন (জন্মগত) কানকাটা দেখতে পাও? অতঃপর আবূ হুরায়রা তিলাওয়াত করলেনঃ (فِطْرَةَ اللَّهِ الَّتِي فَطَرَ النَّاسَ عَلَيْهَا لا تَبْدِيلَ لِخَلْقِ اللَّهِ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ) (যার অর্থ) “আল্লাহর দেয়া ফিত্রাতের অনুসরণ কর, যে ফিত্রাতের উপর তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন, এটাই সরল সুদৃঢ় দ্বীন”- (সূরা রুমঃ ৩০)। [22]সহীহ বুখারি; হাদিস নং- ১৩৫৯
ইসলামি ধর্মতাত্ত্বিক ইমাম গাযালি ফিতরা সম্পর্কে বলেছেন, “আল্লাহর ব্যাপারে জ্ঞানের বিষয়টি এমন যে এটা থাকে প্রত্যকে মানুষের চেতনার গভীরে। [23]কিমিয়ায়ে সাআদাত; দ্যা অ্যালকেমি অভ হ্যাপিনেস। অনুবাদ; ক্লদ ফিল্ড। … Continue reading
এছাড়া, বিখ্যাত মনীষী ইবনু তাইমিয়্যা ফিতরা সম্পর্কে বলেছেন,
ফিতরা থেকেই একজন নিপুণ স্রষ্টার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এই জ্ঞান অমোচনীয়,অনিবার্য এবং সুস্পষ্ট। [24]মাজমুউল-ফাতওয়া শাইখুল ইসলাম আহমাদ বিন তাইমিয়্যা। মাদিনা; মুজামা’মালিক … Continue reading
এছাড়াও, ইবনু তাইমিয়্যা ফিতরা সম্পর্কে বলেছেন,
একজন সৃষ্টিকর্তার বিশ্বাস সকল মানুষের অন্তরে গাঁথা আছে, একটা তাদের সৃষ্টির আবশ্যিক শর্ত থেকে। [25]দার তারুদ আল-আকল ওয়ান-নাকল। ২য় সংস্করণ। সম্পাদনা; মুহাম্মদ রাশাদ সালিম, … Continue reading
বিংশ শতাব্দীর প্রখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ শায়েখ সাঈয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী (রহ.) ফিতরাত সম্পর্কে বলেন,
যে মানুষ আল্লাহকে চেনেনা, যে তাকে অস্বীকার করে, যে আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে পূজা করে এবং আল্লাহর কর্তিতবের ক্ষেত্রে অন্য কাউকে অংশীদার করে, স্বভাব প্রকৃতির (ফিতরাত) দিক দিয়ে সেও মুসলিম, কারণ তার জীবন মৃত্যু সব কিছুই আল্লাহর বিধানের অনুসারী।….. যে মাথাকে জোরপূর্বক আল্লাহ ছাড়া অপরের সামনে অবনত করছে, সেও জন্মগতভাবে মুসলিম, অজ্ঞতার বশে যে হৃদয় মধ্যে সে অপরের প্রতি সম্মান ও ভালোবাসা পোষণ করে,তাও সহজাত প্রকৃতিতে মুসলিম। [26]সাঈয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী; ইসলাম পরিচিতি, পৃষ্টা নং- ৮
নাস্তিকতা কি স্বভাবজাত ?
উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে নাস্তিকতা সহজাত বা স্বতঃসিদ্ধ কিছু নয়, বরং অর্জিত অবস্থা। প্রাথমিকভাবে যেহেতু একজন স্রষ্টার মৌলিক ধারণার বিষয়টি সত্য, কাজেই কেউ যদি স্রষ্টার অস্তিত্ব অস্বীকার করে তখন আমাদের যে প্রশ্নটি করা উচিত তা হচ্ছেঃ স্রষ্টার অস্তিত্ব অস্বীকারের কী প্রমাণ আছে তাদের কাছে?
কারণ, যেকোনো স্বতঃসিদ্ধ সত্যের সত্যতা নিয়ে কেউ চ্যালেঞ্জ করলে তা প্রমাণ করার দায় চ্যালেঞ্জকারীর উপর।
Home – Faith and Theology (faith-and-theology.com)
References
↑1 | https://www.scientificamerican.com/article/are-we-living-in-a-computer-simulation/ |
---|---|
↑2 | দর্শনের সমস্যাবলি; পৃষ্ঠা নং- ৫৭ |
↑3 | সরদার ফজুলল করিম, দর্শনকোষ, ২২৪-২২৫ পৃষ্ঠা |
↑4 | Children are born believers in God, academic claims |
↑5 | ARE WE BORN BELIEVERS? |
↑6 | প্রাগুক্ত |
↑7 | Born Believers: The Science of Children’s Religious Belief |
↑8 | BBC Today; Are we born believing in God? |
↑9 | Key psychological issues in the study of religion |
↑10 | Infants ‘have natural belief in God’ |
↑11 | Robert N.McCauley, Why Religion is Natural and science is not. page;221 |
↑12 | Paul bloom religion is natural journal of developmental science 10:1 p 147-151 |
↑13 | Are Children ‘‘Intuitive Theists’’? Reasoning About Purpose and Design in Nature. |
↑14 | Patrick Mcnamara Ph.D, Wesley J. Wildman (etd.), Science and the World’s Re-ligions; vol. 02 (persons and Groups), p.206,209 (Publisher ABC-CLIO, July 19,2012) |
↑15 | The divided mind of a disbeliever: Intuitive beliefs about nature as purposefully created among different groups of non-religious adults |
↑16 | The Existence of God: A Philosophical Introduction; Page-57-58 |
↑17 | Elizabeth king, I’m an atheist. So why can’t I shake God? The washington post, February 4,2016 |
↑18 | Tim Ross, Belief in God is part of human nature – Oxford study. The Telegraph,12may2011 |
↑19 | Pascal Boyer, Bound to Believe?;Nature,Vol.455,p.1038-1038 |
↑20 | সূরা আর-রুম; ৩০ঃ৩০ |
↑21 | সূরা আরাফ:১৭২ |
↑22 | সহীহ বুখারি; হাদিস নং- ১৩৫৯ |
↑23 | কিমিয়ায়ে সাআদাত; দ্যা অ্যালকেমি অভ হ্যাপিনেস। অনুবাদ; ক্লদ ফিল্ড। কুয়ালালামপুর; ইসলামি বুক ট্রাস্ট,পৃষ্ঠা;৩৪২ |
↑24 | মাজমুউল-ফাতওয়া শাইখুল ইসলাম আহমাদ বিন তাইমিয়্যা। মাদিনা; মুজামা’মালিক হাদাদ। খন্ড ১৬ পৃষ্ঠা ৩২৪। |
↑25 | দার তারুদ আল-আকল ওয়ান-নাকল। ২য় সংস্করণ। সম্পাদনা; মুহাম্মদ রাশাদ সালিম, জামিআ আল-মুহাম্মদ বিন সাউদ আল-ইসলামিয়া। খন্ড ৮, পৃষ্ঠা ৪৮২ |
↑26 | সাঈয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী; ইসলাম পরিচিতি, পৃষ্টা নং- ৮ |
মাশা-আল্লাহ
নাস্তিকতা নিপাক যাক