বিজ্ঞানের দর্শন
আস্তিকতা নাস্তিকতা ও ফিলোসফিক্যাল বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি উপলব্ধি করেছি তা হলো, বর্তমান প্রজন্মের অধিকাংশ লোক সাইন্টেজিম বা বিজ্ঞানবাদে আক্রান্ত।
বর্তমান যুগকে বলা হয় বিজ্ঞানের যুগ। বিজ্ঞান আমাদের পুরো জীবনকে বদলে দিয়েছে, বদলে দিয়েছে পুরো দুনিয়াকে। মানুষের জীবন যাত্রায় বিজ্ঞান যে পরিবর্তন সাধন করতে পেরেছে তা আর জ্ঞানের অন্য কোনো শাখা করতে পারেনি। আমি পিসিতে বসে লিখতেছি, মুটোফোন দিয়ে মুহূর্তের মধ্যেই বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে আপনি চাইলে যোগাযোগ করতে পারেন। বিজ্ঞানের এরকম অজস্র উদাহারণ আমাদের চোখের সামনে প্রতিনিয়ত দেখতে পাচ্ছি। বিজ্ঞানের এই সফলতার কারণেই বর্তমান প্রজন্মের অধিকাংশ লোক বিজ্ঞান সম্পর্কে বিভিন্ন মিথ্যা ধারণা নিচ্ছে। বিজ্ঞানের মতকে তারা যক্ষের ধণের মতো আগলে রাখে।
বিজ্ঞান কোনো বিষয়ে যা ব্যাখা দিক সেটা গিলে খাবে, কিন্তু বিজ্ঞান ব্যাখ্যা দিতে পারেনি তো দ্বিধাহীন কন্ঠে তা অস্বীকার করার প্রবণতা প্রখর এই শ্রেণির লোকের মাঝে। ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় বিজ্ঞানকে সৃষ্টিকর্তার আসন বা উপসানার আসনেও বসিয়ে দিচ্ছে অনেকেই। বিজ্ঞানকে মনে করে সত্যের মাপকাটি বা পুতপবিত্র মহান মনে করে। বাংলাদেশে কথিত বুদ্ধিজীবি জাফর ইকবাল তার লিখিত আরো একটু খানি বিজ্ঞান বইতে এমনটাই দাবি করেছেন। রেফারেন্সঃ [1]জাফর ইকবাল;আরো একটু খানি বিজ্ঞান; পৃষ্টা নং-১৭
দার্শনিক ব্রাট্রান্ড রাসেল বলেন,
যা যা জ্ঞান অর্জন সম্ভব তা কেবল মাত্র বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতেই সম্ভব। বিজ্ঞান যা আবিষ্কার করতে পারবেনা তা কখনোই আমরা জানতে পারবোনা। রেফারেন্সঃ [2]Samir okasha (2016), Philosophy of science: A very short introduction (Oxford university press,2nd edition) Page: 115
বিজ্ঞানের তারিফ করা বা বিজ্ঞানকে ভালোবাসায় কোনো সমস্যা নেই। অথচ জগতের সব বিষয় জানা বা সত্য জানার একমাত্র তরিকা কিন্তু বিজ্ঞান নয়। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মাঝেও অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাই বিজ্ঞানবাদ বা সাইন্টিজমে আক্রান্ত লোকদের জন্য বিজ্ঞানের দর্শন লেখাটি।
বিজ্ঞান কি?
Scientia থেকে ইংরেজি Science শব্দটির উৎপত্তি। যার অর্থ হলো জ্ঞান।ভৌত বিশ্বের যা কিছু পর্যবেক্ষণযোগ্য, পরীক্ষণযোগ্য ও যাচাইযোগ্য এবং তার গবেষণা ও তার ফলাফল দেওয়ার মানবীয় চেষ্টাই হলো বিজ্ঞান।
Cambridge dictionary তে বিজ্ঞানের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে,
ভৌত জগতের গঠন এবং আচরণের যত্ন সহকারে অধ্যয়ন, বিশেষ করে পর্যবেক্ষণ, পরিমাপ এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে, এবং এই ক্রিয়াকলাপের ফলাফলগুলি বর্ণনা করার জন্য তত্ত্বগুলির বিকাশ।[refSCIENCE | English meaning – Cambridge Dictionary][/ref]
“বিজ্ঞান কি?” এ সম্পর্কে ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেস এর বিজ্ঞানীরা আলোকপাত করেছেন,
Science is a way of knowing about the natural world. It is limited to explaining the natural world through natural causes. Science can say nothing about the supernatural. Whether God exists or not is a question about which science is neutral. অর্থাৎ, বিজ্ঞান প্রাকৃতিক জগৎ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের একটি উপায়। প্রাকৃতিক জগৎ সম্পর্কে জাগতিক ব্যাখ্যা প্রদানে এটি সীমাবদ্ধ। বিজ্ঞান অতিপ্রাকৃত সম্পর্কে কিছুই বলতে পারে না। স্রষ্টা আছেন নাকি নেই- এ প্রশ্নের ব্যাপারে বিজ্ঞান নিরপেক্ষ। [3]Teaching About Evolution and the Nature of Science. Page; 58.
গণিতবিদ ও বিজ্ঞান দার্শনিক ব্রাট্রান্ড রাসেল বলেছেন,
পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আবিষ্কারের চেষ্টা এবং এর ওপর ভিত্তি করে যুক্তি দেখানো…..পৃথিবীর কোনো নির্দিষ্ট ঘটনা সম্বন্ধে এবং ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নিয়ম সম্বন্ধে। [4]রাসেল, বি. (১৯৩৫) রিলিজিয়ন অ্যান্ড সায়েন্স। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, … Continue reading
নিউ মেক্সিকো ইউনিভার্সিটির ইমেরিটাস অধ্যাপক ম্যানুয়েল মোলস বলেন,
Broadly speaking, science is a way of obtaining knowledge about the natural world using certain formal procedures. অর্থাৎ, ব্যাপকভাবে বলতে গেলে, বিজ্ঞান হল কিছু আনুষ্ঠানিক পদ্ধতি ব্যবহার করে প্রাকৃতিক জগত সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের একটি উপায়। [5]Ecology: Concepts and Applications. Page; 511.
তবে বিজ্ঞানের সংজ্ঞা নিয়ে দার্শনিকদের মধ্যে বিতর্কও রয়েছে। ব্রিস্টল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক জেমস লেডিম্যান বলেন,
We may not yet know how to define science or how to tell whether certain contentious activities or beliefs count as scientific or not, but we certainly have lots of example of Science. অর্থাৎ, আমাদের সামনে বিজ্ঞানের অজস্র উদাহরণ থাকলেও বিজ্ঞানকে কিভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায় কিংবা কোন ধরণের বিতর্কমূলক কার্যকম বা বিশ্বাস কে বৈজ্ঞানিক বলা হবে তা আমরা জানি না! [6]James Ladyman; Understanding Philosophy Of Science. Page: 4
সুতরাং, আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, পর্যবেক্ষণ, পরিক্ষা-নিরিক্ষার মাধ্যমে আমাদের এই মহাবিশ্বের গঠন, এর মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোকে ব্যাখা প্রদান করাই হলো বিজ্ঞান।
বিজ্ঞান কিভাবে কাজ করে ?
ভৌত বিশ্বের যা কিছু পর্যবেক্ষণযোগ্য, পরীক্ষণযোগ্য ও যাচাইযোগ্য, এবং তার গবেষণা এবং সে ফলাফল বিজ্ঞান।
অর্থাৎ,যা ভৌত নয়, পর্যবেক্ষণ ও পরিমাপ যোগ্য নয় তা নিয়ে বিজ্ঞান আলোচনা করেনা। যেমন, আমাদের মানব দেহ একটা ভৌতবস্তু। তাই বিজ্ঞান মানব দেহ নিয়ে আলোচনা করে। কিন্তু আমাদের দেহের সৌন্দর্য ভৌতবস্তু নয়। তাই বিজ্ঞান সৌন্দর্য্য নিয়ে আলোচনা করেনা। সৌন্দর্য বিষয়ে আলোচনা করার জন্য “নন্দনতত্ত্ব”(Aesthetic) নামে আলাদা একটা শাস্ত্র রয়েছে। একইভাবে আমাদের মন, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, স্রষ্টার অস্তিত্ব, আত্মা, পরকাল ইত্যাদি বিষয়ে বিজ্ঞান আলোচনা করেনা। এসব বিষয়ে অধিবিদ্যা বা মেটাফিজিক্স আলোচনা করে। ।
বিজ্ঞান কোনো কিছুকে প্রথমে পর্যবেক্ষণ করে হাইপোথেসিস উপস্থাপন করবে এবং সেই হাইপোথেসিসকে ধাপে ধাপে পরিক্ষা-নিরিক্ষার মাধ্যমে একটি থিওরি বা তত্ত্ব উপস্থাপন করে। তত্ত্বকে চাইলেই যেকোনো সময় পরীক্ষা করা যাবে, যাচাই করা যাবে।
থিওরি হচ্ছে বিজ্ঞানের নির্ভুলতার সর্বোচ্চ স্তর। তবে বৈজ্ঞানিক থিওরি যতই শক্তিশালী হোক না কেন থিওরি কখনো absolutely truth বা চূড়ান্ত সত্য নয়। বিজ্ঞান কখনোই আমাদের নিশ্চিত জ্ঞান পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারেনা।
বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা
ভৌত বিষয় সম্পর্কে বিজ্ঞানের চেয়ে বেশি জ্ঞান জ্ঞানের অন্য কোনো শাখা দিতে পারবেনা। কিন্তু বিজ্ঞান কখনোই আমাদের চূড়ান্ত সত্য জানাতে পারেনা। বিজ্ঞানের অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বিজ্ঞানের মূল সীমাবদ্ধতাগুলোর মধ্যে রয়েছে,
ভালো মন্দ বা নৈতিকতা নির্ধারণ করতে পারেনা
বিজ্ঞান আমদের নৈতিকতার কোন ভিত্তি দিতে পারেনা। মনে করুন, আপনার এক বন্ধু কোনো মানুষের শরীরে ছুরি ঢুকালো। ছুরি ঢুকানোর পর কী কী হয় বিজ্ঞান আমাদের প্রায় সব বলে দিতে পারে। কিন্তু এই কাজটা কি ভালো নাকি মন্দ তা বিজ্ঞান আমাদের বলতে পারেনা।
কেন এর উত্তর দিতে পারেনা
মনে করুন, আপনার একজন প্রতিবেশি আপনার জন্য আপনার খুব পছন্দের কেক রান্না করে দিয়ে গেল। আপনি খাবারটি সানন্দে গ্রহণ করে হাসিমুখে খেতে বসলেন। হঠাৎ আপনার মনে প্রশ্ন জাগলো, তিনি আমার জন্য কেন আমার পছন্দের খাবার কেক রান্না করলো ? বেশ কিছু পরিক্ষা-নিরিক্ষ করার পর আপনি বের করলেন, কেক কি কি উপাদান দিয়ে বানানো হয়েছে, কেকের সাইজ কত, কত ডিগ্রি তাপমাত্রায় কেকটি তৌরি করা হয়েছিল। এতো কিছু জানার পরেও কিন্তু আপনি এটা জানতে পারবেন না যে, কেন আপনার প্রতিবেশি আপনার জন্য কেকটি তৌরি করেছে। এই উদাহারণ থেকে আমরা বুঝতে পারি, বিজ্ঞান আমাদের “কেন” প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনা। “কি” প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে।
ফাস্ট প্রিন্সিপাল নিয়ে আলোচনা করেনা
ফাস্ট প্রিন্সিপাল বলতে বুঝায়, যা কিছু আমরা কোনো প্রকার যুক্তি বা প্রমাণ ছাড়াই বিশ্বাস করি। যেমনঃ আমাদের এই মহাবিশ্ব, বা ২+২=৪ ইত্যাদি।
যে জীবনকে আমরা বাস্তব বলে মনে করি এই জীবন কি স্রেফ স্বপনের মতো কোনো ব্যাপার ? নাকি আদৌ এর বাস্তব অস্তিত্ব আছে ? আপনি কি কখনো প্রমাণ করতে পারবেন আপনার এই জীবন আসলেই বাস্তব ? আমাদের ইন্দ্রিয়ের অনুভূতি এই জগৎ যে বাস্তবে অস্তিত্বশীল, তা প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট নয়। এমনকি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যাবহার করেও আমরা প্রমাণ করতে পারবোনা যে আমাদের এই মহাবিশ্বের আসলেই অস্তিত্ব রয়েছে। কারণ বিজ্ঞান নিজেই এটা কোনো প্রকার প্রমাণ ছাড়াই এটা বিশ্বাস করে যে আমাদের এই মহাবিশ্ব আসলেই অস্তিত্বশীল।
এক্সটার্নাল ইউনিভার্স বাস্তবে অস্তিত্বে আছে কিনা তা প্রুফ করতে পারবোনা। কিন্তু এর মানে এই না যে আমরা এক্সটার্নাল ইউনিভার্সের অস্তিত্বকে নাকচ করে দিব। বরং আমরা কোনো যুক্তি প্রমাণ ছাড়াই প্রকৃতিগত ভাবেই আমরা এই জগতকে বাস্তব বলে মনে করি।
এহেন প্রাকৃতিক বিশ্বাসগুলো নিয়ে বিজ্ঞান আলোচনা করেনা। বরং বিজ্ঞান এগুলো মেনে নেয়।
অধিবিদ্যাগত বিষয়ে আলোচনা করেনা
ভৌত বিশ্বের যা কিছু পর্যবেক্ষণযোগ্য, পরীক্ষণযোগ্য ও যাচাইযোগ্য তা নিয়েই বিজ্ঞান আলোচনা করে। আমাদের মন, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, স্রষ্টার অস্তিত্ব, আত্মা, পরকাল, একটি সচেতন প্রাণির একান্ত ব্যাক্তিগত অনুভূতি কেমন? এই ধরণের প্রশ্নগুলো পর্যবেক্ষণযোগ্য জগতের বাইরে বলে বলে বিজ্ঞান এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে অপারগ।এসব বিষয়ে অধিবিদ্যা বা মেটাফিজিক্স আলোচনা করে।
Spatial Space
মনে করুন, আপনি বাংলাদেশের যে কোনো একটা জায়গাতে আকাশের দিকে বল ছুঁড়ে মারলেন। তো বলটি আবার আপনার দিকেই ফিরে আসবে। কিন্তু আপনার পক্ষে এটা সম্ভব না যে পৃথিবীর সব জায়গায় বল নিচের দিকে ফিরে আসে কিনা তা নির্ণয় করা।
Spatial Time
মনে করুন, আপনি আকাশের দিকে বল ছুঁড়ে মারলেন এবং বলটি নিচে পরে গেল। এখন ১৯৬০ সালেও কি ঠিক একই ঘটনা ঘটতো কিনা তা আপনি বিজ্ঞান দিয়ে প্রমাণ করতে পারবেন না। কারণ সেটা অতীত।
বিজ্ঞান সত্য নির্ণয়ের মাধ্যম ? অথবা বিজ্ঞান কি নিশ্চয়তা দিতে পারে ?
বিজ্ঞান নিয়ে অনেক বড় বড় দার্শনিক, বিজ্ঞানিদের ভুল ধারণা রয়েছে। বিশেষ নাস্তিক বিজ্ঞানি বা দার্শনিকদের মাঝে। তারা বিজ্ঞানের থিওরিকে বা বিজ্ঞান কোনো কিছু দাবি করলে সেটাকে পরম সত্য হিসেবে ধরে নেয়। কিন্তু বিজ্ঞান কখনোই আমাদের চূড়ান্ত সত্য জানাতে পারেনা।
দার্শনিক ব্রাট্রান্ড রাসেল বলেন,
যা যা জ্ঞান অর্জন সম্ভব তা কেবল মাত্র বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতেই সম্ভব। বিজ্ঞান যা আবিষ্কার করতে পারবেনা তা কখনোই আমরা জানতে পারবোনা। [7]Samir okasha (2016), Philosophy of science: A very short introduction (Oxford university press,2nd edition) Page: 115
বাংলাদেশে কথিত বুদ্ধিজীবি জাফর ইকবাল তার লিখিত আরো একটু খানি বিজ্ঞান বইতে এমনটাই দাবি করেছেন। [8]জাফর ইকবাল;আরো একটু খানি বিজ্ঞান; পৃষ্টা নং-১৭
কিন্তু তাদের এই কথাই (বিজ্ঞান সত্য জানার মাধ্যম) বিজ্ঞান দিয়ে প্রমাণ করার কোনো উপায় নেই। আপনি লজিক দিয়ে লজিক প্রমাণ করতে পারবেন না। যখন আপনি এই কাজটি করতে যাবেন তখন সার্কুলার রিজনিং ফ্যালাসি ঘটবে।
বরং এটা এমন একটি আত্মঘাতী কথা যে, “বাংলা বাক্যে তিন শব্দের চেয়ে বড় কোনো বাক্য নেই।” এই বাক্যেই কিন্ত তিন শব্দের চেয়ে বড় শব্দ রয়েছে।
“বিজ্ঞান সত্য জানার মাধ্যম” এটা নিজেই একটা মেটাফিজিক্যাল স্টেটমেন্ট যেটাকে আমরা চাইলেই বিজ্ঞান দিয়ে প্রমাণ করতে পারবোনা।
যেটা সত্য সেটা সব সময় সত্য। সত্যের মধ্যে মিথ্যা হবার সম্ভাবনা থাকেনা। কিন্তু বিজ্ঞানের থিওরি মিথ্যা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই আমার প্রেমিস হচ্ছে,
১. যা কিছু সত্য তা সব সময়ের জন্য সত্য।
২. যা যা সত্য তার ভেতরে মিথ্যা হওয়ার অথবা সত্য পরিবর্তন পসিবিলিটি নাই।
৩. বিজ্ঞানের থিওরি বা দাবি সব সময়ের জন্য সত্য নয়, বরং পরিবর্তনশীল।
সুতরাং, বিজ্ঞান সত্য নির্ণয়ের মাধ্যম নয়। অথবা, বিজ্ঞান কি নিশ্চয়তা দিতে পারে না।
৩নং প্রেমিসের প্রমাণ হিসেবে আমরা নিউটনের তত্ত্বকে ধরে নিতে পারি। নিউটনের তত্ত্ব বিজ্ঞান মহলে পুরো দুইশত বছর টিকে ছিল। এই দুইশত বছর বিজ্ঞান পূজারি থেকে সাধারণ মানুষও এই তত্ত্বকে সত্য হিসেবে ধরে নিয়েছিল। কিন্তু আলবার্ট আইনস্টাইন নিউটনের তত্ত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দেয়।
বৈজ্ঞানিক থিওরি বেশ কিছু কারণে আমাদের নিশ্চিত জ্ঞান পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারেনা। তার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হচ্ছে, 1. The problem of induction 2. Scatter graph problem
The problem of induction
The problem of induction অনেকটা এরকম যে, পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা বৃদ্ধি হওয়ার সাথে সাথে বৈজ্ঞানিক থিওরিও পরিবর্তন হবে। যেমন; ১৬৬৭ সাল পর্যন্ত ইউরোপে মনে করা হতো, পৃথিবীর সকল হাস সাদা। কেননা ততদিন পর্যন্ত আমাদের পর্যবেক্ষনলদ্ধ সকল হাস ছিলো সাদা রঙ’এর। কিন্তু ১৬৯৭ সালে উইলিয়াম দ্যা ব্লামিং অস্ট্রেলিয়াতে কালো রাজ হাস আবিষ্কার করেন। এতে করে (All swans are white and have always been white) এই তত্ত্বটি ভুল প্রমাণ হয়ে যায়। সুতরাং পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা যত বাড়বে তত বৈজ্ঞানিক থিওরী পরিবর্তন হবে। এটাই হলো problem of induction.
Scatter graph problem
Scatter graph problem হচ্ছে, একই পর্যবেক্ষণ থেকে একাধিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া। যেমন; আমাদের কাছে ১০০টি বিন্দু রয়েছে। এগুলো হলো তথ্য। আমাদেরকে যদি এই তথ্য থেকে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে বলা হয় তাহলে দেখা যাবে, কেউ এগুলো দিয়ে একটা সরলরেখা তৌরি করেছে। কেউ বক্ররেখা তৌরি করেছে। কেউ ত্রিভূজ, চতুভূজ, বর্গক্ষেত্র তৌরি করেছে। অর্থাৎ, একই পর্যবেক্ষণ ও তথ্য অনেকগুলো তত্ত্বের সম্ভাবনা রাখে। সম্ভাব্য তত্ত্বগুলো ক্রমান্বয়ে পরিবর্তন হওয়ার ফলে বৈজ্ঞানিক থিওরিও প্রতিনিয় পরিবর্তন হয়। যার ফলে থিওরি কখনোই আমাদের নিশ্চিত জ্ঞান পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনা। এটাই হচ্ছে Scatter graph problem.
বিশেষজ্ঞদের মত
প্রখ্যাত পদার্থবিদ ফ্রিম্যান ডাইসন নিউ ইয়র্ক রিভিউতে এক আর্টিকেলে লিখেন,
The public has a distorted view of science, because children are taught in school that science is a collection of firmly established truths. In fact, science is not a collection of truths. It is a continuing exploration of mysteries. অর্থাৎ, বিজ্ঞান সম্পর্কে মানুষজনের একটা বিকৃত দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। বাচ্চাকাচ্চাদের স্কুলে শেখানো হয় যে, বিজ্ঞান হচ্ছে সুপ্রতিষ্ঠিত সত্যের সমাহার! আসলে বিজ্ঞান কোন ‘কালেকশন অব ট্রুথ’ নয়। বিজ্ঞান হচ্ছে ক্রমাগত রহস্যোন্মোচন।” “Science is not a collection of Truths [9]https://www.goodreads.com/quotes/360178-the-public-has-a-distorted-view-of-science-because-children
Stanford Encyclopedia of Philosophy তে বলা হয়ছে,
বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলোর একটা নির্দিষ্ট মেয়াদ রয়েছে। বিজ্ঞানের ইতিহাসের দিকে একটু লক্ষ করলে একসময়ে প্রভাবশালী ও গ্রহণযোগ্য এমন অনেক তত্ত্ব চোখে পড়বে, যেগুলো আজ বিজ্ঞানের ইতিহাসে পড়ানো হচ্ছে। অর্থাৎ সেগুলো আর গ্রহণযোগ্য নয়। [10]https://plato.stanford.edu/entries/realism-theory-change/
মনোবিজ্ঞানি কিথ স্ট্যানোভিচ বলেন,
বিজ্ঞান ইতঃপূর্বে যা সত্য বলে প্রমাণ করেছিল, তাকেই প্রতিনিয়ত মিথ্যা প্রমাণ করে চলেছে। [11]Stanovich, Keith E.. How to think straight about Psychology. Boston: Pearson Education. Page-106-107
রবীন্দ্রনাথ তার ‘হৈমন্তি গল্পের একটা অংশে লিখেছে, ” মানুষ পণ করে পণ ভাঙিয়া ফেলিয়া হাঁফ ছাড়িবার জন্য।” রবীন্দ্রনাথের এই লাইনের সাথে মিল রেখে যদি বলি, ” বিজ্ঞানীরা তত্ত্ব দেন তত্ত্বকে ভুল প্রমাণ করে হাঁফ ছেড়ে বাঁচার জন্য। ” বিষয়টা মন্দ হয়না।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে বিজ্ঞান সত্য নির্ণয়ের মাধ্যম হতে পারেনা।
বিজ্ঞানের বিশ্বাস
অনেক নাস্তিক ও বিজ্ঞানপূজারিরা দাবি করে বিজ্ঞানে বিশ্বাসের কোনো স্থান নেই। যেমন, বাংলাদেশের কথিত বুদ্ধিজীবী জাফর ইকবাল তার একটুখানি বিজ্ঞান বইতে লিখেছে,
ধর্মের ভিত্তি হচ্ছে বিশ্বাস, কাজেই ধর্মগ্রন্থে যা লেখা থাকে সেটাকে কেউ কখনো প্রশ্ন করে না, গভীর বিশ্বাসে গ্রহণ করে নেয়। বিজ্ঞানে বিশ্বাসের কোনো স্থান নেই। [12]জাফর ইকবাল, আরো একটুখানি বিজ্ঞান; পৃষ্ঠা; ১৩
কিন্তু সত্য হচ্ছে বিজ্ঞান কিছু অনুমানের উপর দাঁড়িয়ে আছে। অর্থাৎ, বিজ্ঞান যখন কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তা করা শুরু করে তখন কিছু পূর্বধারণা কে সঠিক বলে ধরে নেয়। যেমন আমাদের এই মহাবিশ্ব যে অস্তিত্বশীল এটাও বিজ্ঞান বিশ্বাস করে নেয়।
ক্যালিফোর্নিয়ার প্রগ্রেসিভ সাইন্স ইন্সটিউট এর পরিচালক, নাস্তিক বিজ্ঞান দার্শনিক গ্লেন বরচার্ড The Ten Assumptions of science Towards a New Scientific Worldview গ্রন্থে এমন দশটি অনুমান নিয়ে আলোচনা করেছেন যেগুলো বিজ্ঞান নিশ্চিত প্রমাণ ছাড়াই চোখ বন্ধ করে মেনে নেয়। [13]The Ten Assumptions of Science Towards a New Scientific Worldview. অনুমানগুলো হলো, Materialism, Causality, Uncertainty, Inseparability, Conservation, Complementarity, … Continue reading
আইনস্টাইন এর মতে,
মহাবিশ্বের যে আসলেই অস্তিত্ব আছে , এহেন বিশ্বাস সকল প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ভিত্তি। [14]Glenn Borchardt, The Ten Assumptions of science: Towards a New Scientific Worldview; Page; 14
মনোবিজ্ঞানি কিথ স্ট্যানোভিচ এর মতে,
বিজ্ঞান ইতঃপূর্বে যা সত্য বলে প্রমাণ করেছিল তাকেই প্রতিনিয়ত মিথ্যা প্রমাণ করে চলছে। [15]Stanovich, Keith E.. How to think straight about Psychology. Boston: Pearson Education. Page-106-107
দার্শনিক আর.জি.কলিংউড বলেছেন,
বিজ্ঞান আগে থেকেই অনুমান করে নেওয়া কিছু ধারণার উপর নির্ভরশীল। বিজ্ঞান ফ্যাক্ট নয়, বরং বিশ্বাস এর উপর দাঁড়িয়ে আছে এমনটা বলা যায়। [16]Glenn Brockman, The Ten Assumptions of Science Towards a New Scientific Worldview; Page.19
বিজ্ঞান কি সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব বাতিল প্রমাণ করেছে ?
বিজ্ঞান কি সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব বাতিল প্রমাণ করেছে? ভৌত বিশ্বের যা কিছু পর্যবেক্ষণযোগ্য, পরীক্ষণযোগ্য ও যাচাইযোগ্য তা নিয়েই বিজ্ঞান আলোচনা করে। অর্থাৎ,যা ভৌত নয়, পর্যবেক্ষণ ও পরিমাপ যোগ্য নয় তা নিয়ে বিজ্ঞান আলোচনা করেনা।
যেমন, আমাদের মানব দেহ একটা ভৌতবস্তু। তাই বিজ্ঞান মানব দেহ নিয়ে আলোচনা করে। কিন্তু আমাদের দেহের সৌন্দর্য ভৌতবস্তু নয়। তাই বিজ্ঞান সৌন্দর্য্য নিয়ে আলোচনা করেনা। সৌন্দর্য বিষয়ে আলোচনা করার জন্য “নন্দনতত্ত্ব”(Aesthetic) নামে আলাদা একটা শাস্ত্র রয়েছে। একইভাবে আমাদের মন, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, স্রষ্টার অস্তিত্ব, আত্মা, পরকাল ইত্যাদি বিষয়ে বিজ্ঞান আলোচনা করেনা। এসব বিষয়ে অধিবিদ্যা বা মেটাফিজিক্স আলোচনা করে। ।
কিন্তু কিছু নাস্তিক ও বিজ্ঞানপূজারি বিজ্ঞান দিয়ে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বকে বাতিল করার ব্যার্থ চেষ্টা করে যাচ্ছে। পর্যবেক্ষন করা এমন জিনিসের সুরাহা বিজ্ঞান করতে পারে, কিন্তু সৃষ্টিকর্তার ডেফিনিশন অনুযায়ী তিনি একম এক সত্তা, যিনি এই মহাজগতের উর্দ্ধে। তাই সৃষ্টিকর্তাকে সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব নয়। তাই সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব বিষয়ে বিজ্ঞান নিরব থাকে।
বিশেষজ্ঞদের মত
বিজ্ঞানের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ফিচার বিজ্ঞান কি সম্পর্কে ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেস এর বিজ্ঞানীরা আলোকপাত করেছেন,
Science is a way of knowing about the natural world. It is limited to explaining the natural world through natural causes. Science can say nothing about the supernatural. Whether God exists or not is a question about which science is neutral. অর্থাৎ, বিজ্ঞান প্রাকৃতিক জগৎ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের একটি উপায়। প্রাকৃতিক জগৎ সম্পর্কে জাগতিক ব্যাখ্যা প্রদানে এটি সীমাবদ্ধ। বিজ্ঞান অতিপ্রাকৃত সম্পর্কে কিছুই বলতে পারে না। স্রষ্টা আছেন নাকি নেই- এ প্রশ্নের ব্যাপারে বিজ্ঞান নিরপেক্ষ। [17]Teaching About Evolution and the Nature of Science. Page; 58.
ডার্ক এনার্জির ধারণা অবিষ্কারের জন্য ২০১১ সালে নোবেল পুরুস্কার পাওয়া টিমের সদস্য নাস্তিক প্রফেসর আলেক্স ফিলিপ্নেনকো RT News কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন,
আমি মহাবিশ্বকে একজন বিজ্ঞানির দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করতে চাই, কোনো অতিপ্রাকৃতিক সত্তা আছে নাকি নেই বা এই মহাবিশ্বের কোনো উদ্দেশ্য আছে কি না, সে বিষয়ে আমি কিছু বলব না কারণ এই প্রশ্নগুলোর উত্তর বিজ্ঞান দিতে পারেনা। [18]‘Scientists only understand 4% of universe’ — RT World News
জীববিজ্ঞানী স্কট টড বিখ্যাত সাইন্স জার্নাল Nature-এ প্রকাশিত এক চিঠিতে বলেন,
জগতের সকল উপাত্ত যদি কোনো বুদ্ধিমান সত্তার দিকে ইঙ্গিত করে, তারপরেও এই ধারণা বিজ্ঞান থেকে বাদ দেওয়া হবে, কারণ এটা প্রকৃতিবাদী (পদ্ধতিগত) নয়। [19]Scott C. Todd, A view from kansas on that evolution debate; Nature,Vol.401, Page; 423
যারা দাবী করে বিজ্ঞান সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব বাতিল প্রমাণ করেছে, তাদের দাবী কতটুকু যুক্তিযুক্ত দাবি বিচার করার এখতিয়ার আপনাদের উপরেই ছেড়ে দিলাম।
বিজ্ঞান ও বিশ্বাস সম্পর্কে জানতে পড়ুনঃ [20]বিজ্ঞান বনাম বিশ্বাস – Faith and Theology (faith-and-theology.com)
এতটুকু লেখা যদি আপনি একটানা পড়ে থাকেন, তাহলে আমার লেখার মান যা-ই হোক, আপনি যে অত্যন্ত উঁচু মানের একজন ধৈর্যশীল পাঠক, তা নিশ্চিত। আপনাকে একরাশ শুভেচ্ছা।
References
↑1, ↑8 | জাফর ইকবাল;আরো একটু খানি বিজ্ঞান; পৃষ্টা নং-১৭ |
---|---|
↑2 | Samir okasha (2016), Philosophy of science: A very short introduction (Oxford university press,2nd edition) Page: 115 |
↑3 | Teaching About Evolution and the Nature of Science. Page; 58. |
↑4 | রাসেল, বি. (১৯৩৫) রিলিজিয়ন অ্যান্ড সায়েন্স। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, পৃষ্ঠা; ৮ |
↑5 | Ecology: Concepts and Applications. Page; 511. |
↑6 | James Ladyman; Understanding Philosophy Of Science. Page: 4 |
↑7 | Samir okasha (2016), Philosophy of science: A very short introduction (Oxford university press,2nd edition) Page: 115 |
↑9 | https://www.goodreads.com/quotes/360178-the-public-has-a-distorted-view-of-science-because-children |
↑10 | https://plato.stanford.edu/entries/realism-theory-change/ |
↑11, ↑15 | Stanovich, Keith E.. How to think straight about Psychology. Boston: Pearson Education. Page-106-107 |
↑12 | জাফর ইকবাল, আরো একটুখানি বিজ্ঞান; পৃষ্ঠা; ১৩ |
↑13 | The Ten Assumptions of Science Towards a New Scientific Worldview. অনুমানগুলো হলো, Materialism, Causality, Uncertainty, Inseparability, Conservation, Complementarity, Irreversibility, Infinity, Relativism, Interconnection . |
↑14 | Glenn Borchardt, The Ten Assumptions of science: Towards a New Scientific Worldview; Page; 14 |
↑16 | Glenn Brockman, The Ten Assumptions of Science Towards a New Scientific Worldview; Page.19 |
↑17 | Teaching About Evolution and the Nature of Science. Page; 58. |
↑18 | ‘Scientists only understand 4% of universe’ — RT World News |
↑19 | Scott C. Todd, A view from kansas on that evolution debate; Nature,Vol.401, Page; 423 |
↑20 | বিজ্ঞান বনাম বিশ্বাস – Faith and Theology (faith-and-theology.com) |
মাশা-আল্লাহ