বিবর্তনের ভ্রুণতাত্ত্বিক প্রমাণ

বিবর্তনবাদ

সূচনা

ডারউইন এক চিঠিতে জানিয়েছিলেন, ভ্রূণতাত্ত্বিক প্রমাণ তার তত্ত্বের পক্ষে সবচেয়ে শক্তিশালী প্রমাণ। (১) যেহেতু ডারউইন নিজে ভ্রূণবিশারদ ছিলেন না, তাই ভ্রূণসংক্রান্ত উপাত্ত অন্যজন থেকে ধার করতে হয়েছিল। এদের মাঝে একজন ছিলেন আর্নেস্ট হেকেল, অন্যজন ভন বেয়ার। মজার ব্যাপার হলো প্রথমজনের প্রমাণ ছিল জালিয়াতিপূর্ণ, আর পরের জনের কথাকে অপব্যাখ্যা করে বিবর্তনের পক্ষে আনা হয়েছিল যা আমরা বিবর্তনীয় চিন্তাধারার ইতিহাস এ দেখেছি।

ডারউইন ভন বেয়ার-এর উপাত্ত উল্লেখ করে বলেন, একই শ্রেণিভুক্ত প্রাণিরা প্রাথমিক ভ্রূণাবস্থায় দেখতে প্রায় একইরকম; কিন্তু পরিণত অবস্থায় এরা পুরো ভিন্ন আকার-আকৃতি ধারণ করে। (২) পাঠ্যবইয়ের ভাষায়, ‘মাছ, উভচর, সরীসৃপ, পাখি ও স্তন্যপায়ীর ভ্রূণগুলোকে প্রথম অবস্থায় পরস্পর থেকে প্রায় পৃথকই করা যায় না।’ (৩) কিন্তু বেয়ারের সিদ্ধান্ত থেকে বেরিয়ে এসে ভ্রূণগত সাদৃশ্য থেকে ডারউইন অনুমান করেন—এসকল প্রাণি হয়তো একই পূর্বপুরুষের বংশধর এবং এদের পূর্বপুরুষ দেখতে কেমন ছিল তাও বোঝা যাবে ভ্রূণের সাধারণ গঠন দেখে। ডারউইনের মতে, প্রাণির ভ্রূণীয় পরিস্ফুটনের দশাগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিণত প্রাণির অনুরূপ নয় বরং নিম্নতর প্রজাতির বয়স্ক প্রাণির অনুরূপ।এই ধারণার বিপক্ষে সরব ছিলেন বেয়ার। তিনি বারবার বলেছেন উচ্চতর প্রাণির ভ্রূণীয় পরিস্ফুটনের দশাগুলো নিম্নতর প্রজাতির বয়স্ক প্রাণির অনুরূপ নয়। ডারউইন তাকে ভুলভাবে উপস্থাপন করেছেন। (৪)উন্নয়নমূলক সাদৃশ্য ; কার্ল ভন বেয়ার   অংশে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে।

 

ভন বেয়ারের পরবর্তীতে আর্নেস্ট হেকেল পুনরায় বায়োজেনেটিক ল নিয়ে কাজ করা শুরু করে। কোনো জীবের ভ্রূণের পরিস্ফুটনের সময় তার পূর্বপুরুষের ক্রমবিকাশের ঘটনাবলি পুনরাবৃত্তি হয়। এই ধারণা ব্যাপক প্রচার লাভ করে। এই তত্ত্বের মূল কথা হল ‘ব্যক্তিজনি জাতিজনিকে পুনরাবৃত্তি করে’ (ontogeny repeats phylogeny)। ব্যক্তিজনি (ontogeny) কথার অর্থ হল কোনো জীবের জীবনের ইতিহাস এবং জাতিজনি (phylogeny) কথার অর্থ হল জীবের জাতির বিবর্তনের ইতিহাস। বিবর্তনের ইতিহাস অনুযায়ী মাছ, উভচর, সরীসৃপ ও পক্ষীর থেকে মানুষের উৎপত্তি ঘটেছে। তাই মানুষের ভ্রূণের সাথে মাছ, উভচর, সরীসৃপ ও পক্ষীর ভ্রূণের যথেষ্ট সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ অবস্থায় কখনোই এই সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায় না। যদিওবা পরবর্তীতে হেকেলের বায়োজেনেটিক ল ভুল প্রমাণিত হয়েছে এবং বিজ্ঞানীরা এটাকে জীববিজ্ঞানের মিথোলজি হিসেবে বর্ণনা করে থাকেন। (৫) প্রকৃতপক্ষে ভ্রুণতাত্ত্বিক মিল বা সাদৃশ্য থাকলেও তা সাধারণ পূর্বপুরুষকে প্রমাণ করছে না।

 

হেকেলের অঙ্গিত ভ্রুণচিত্রে ছিলো অতিমাত্রায় গলদ! ডক্টর মাইকেল কে. রিচার্ডসন এবং তার সহকর্মীরা বিভিন্ন ভ্রুণীয় অংশের বিভিন্ন বাস্তব ফটোগ্রাফ প্রকাশ করেছিলেন। এবং সেগুলোযে হেকেলের এই অঙ্কনগুলির সাথে সরাসরি তুলনা করা দেখা যায় হেকেলের অঙ্কিত চিত্র সুবিধাজনক ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিলো। (৬)

উপরে হেকেলের অঙ্কিত চিত্র এবং নিচে নতুন ধারণকৃত চিত্র; দেখা যাচ্ছে ভ্রূণের যতটা মিল হেকেল দেখিয়েছেন ভ্রুণ ততটাও এক নয়। ছবিসূত্রঃ মাইকেল রিচার্ডসন।

যাইহোক ২০০৮ সালে রবার্ট রিচার্ড Biology & philosophy জার্নালে ” Haeckel Embryo: fraud not proven” শিরোনামে একটি পেপার প্রকাশ করেন। (৭) সম্পূর্ণ পেপারে রিচার্ড এর মৌলিক যুক্তি প্রায় ৩০০ শব্দের মধ্যে নিহিত। তিনি দাবি করছেন হেকেলের অঙ্কিত চিত্রের ভুলগুলো আসলে প্রযুক্তিগত সমস্যা। অন্যদিকে ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত মাইকেল রিচার্ডসন তার পেপারে দেখিয়েছেন যে ভ্রুণীয় মিল যেমনটা হেকেল উপস্থাপন করেছেন বাস্তবতা তার ঠিক উলটো। রিচার্ডসন ২০০৮ এর রিসার্চ পেপার এ মাইকেল রিচার্ডসনের গবেষণার কথা উল্লেখ করলেও তার যুক্তিসমূহের কোনো কিছু কে বাতিল করতে পারেননি। এতে বোঝা যাচ্ছে হেকেলের সেকেল অঙ্কিত চিত্র কেবল প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা বলে এড়িয়ে যাওয়াটা সম্ভব নয়। (৮) তাছাড়া ২০০১ সালে মাইকেল রিচার্ডসন পুনরায় ন্যাচার জার্নালের এক পেপারে দেখিয়েছেন হেকেল ভ্রুণীয় মিল রাখার জন্য অন্যান্য প্রানীর limb মুছে দিয়ে ছবি অঙ্কন ও করেছেন। (৯) এবং রিচার্ডসন এসকল যুক্তিসমুহের কোনোটিকেই ভুল প্রমাণ করতে পারেনি। ভ্রুণতাত্ত্বিক প্রমাণ সাধারণ পূর্বপুরুষের প্রমাণ নয় যেমনটা এন্ড্রু ইংকপেন এবং ফোর্ড ডু লিটল তাদের গবেষণাপত্রে বলেন,

” বিবর্তনীয় রুপবিদ্যা (Morphology) ধরে নিল যে ভ্রুনীয় উপাত্ত সাধারণ পূর্বপুরুষ নির্ধারণের জন্য নির্ভরযোগ্য একটি সুচক হবে এবং এর দ্বারা হোমোগলাস বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করার একটা উপায় থাকবে কিন্তু আদোতে তা হয়নি। ” (১০)

আমরা দেখতে পাচ্ছি জীবের মধ্যকার সাংগঠনিক সাদৃশ্য ও সাধারণ পূর্বপুরুষের ধারণাকে প্রমাণ করতে ব্যর্থ। যদিওবা আমরা জানি সাদৃশ্যের ভিত্তিতে সাধারণ পূর্বপুরুষই অনুমান করার কোনো উপায় নেই এই সাদৃশ্যের কারণ সাধারণ নকশা ( common design) ও হতে পারে।

 

রেফারেন্সঃ

1.Charles Darwin (1860), Letter to Asa Gray, September 10

2.Charles Darwin (1859), On the Origin of Species by Means of Natural Selection (London: John Murray, 1st ed.) p. 442, 449

3.জীববিজ্ঞান দ্বিতীয় পত্র, একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি; পৃ. ৩৪৭

4.Peter J. Bowler (2003), Evolution: The History of an Idea (University of California Press) p. 124-126

5.Blechschmidt, Erich (1977). The beginnings of human life. New York: Springer-Verlag. p. 32

6.Richardson, M. K., Hanken, J., Gooneratne, M. L., Pieau, C., Raynaud, A., Selwood, L., & Wright, G. M. (1997). There is no highly conserved embryonic stage in the vertebrates: implications for current theories of evolution and development. Anatomy and embryology, 196(2), 91–106. https://doi.org/10.1007/s004290050082

7. Richards, R.J. Haeckel’s embryos: fraud not proven. Biol Philos 24, 147–154 (2009). https://doi.org/10.1007/s10539-008-9140-z

8. Richardson, M. K., Hanken, J., Gooneratne, M. L., Pieau, C., Raynaud, A., Selwood, L., & Wright, G. M. (1997). There is no highly conserved embryonic stage in the vertebrates: implications for current theories of evolution and development. Anatomy and embryology, 196(2), 91–106. https://doi.org/10.1007/s004290050082

9.https://www.nature.com/articles/35065834#ref-CR

10.Inkpen, S.A., Doolittle, W.F. Molecular Phylogenetics and the Perennial Problem of Homology. J Mol Evol 83, 184–192 (2016). https://doi.org/10.1007/s00239-016-9766-4

 

Asief Mehedi

Assalamualaikum to all.My name is Asief Mehedi . I am an informal philosophy student. Let's talk about comparative theology, we work to suppress atheism. Help us to suppress atheism and come forward to establish peace.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button