যুক্তিবিদ্যা কি ?

যুক্তিবিদ্যা কি ? 

যুক্তিবিদ্যা শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ হচ্ছে ‘Logic’। এই শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ Logike থেকে। গ্রীক ভাষায় Logike শব্দের অর্থ বিশ্লেষণ। Logos শব্দের অর্থ চিন্তা, অনুমান। এই ক্ষেত্রে আমরা বলতে পারি যে চিন্তা যখন ভাষায় প্রকাশিত হয় তখনই তা যুক্তিবিদ্যাতে পরিণত হয়। একারণে যুক্তিবিদ্যাকে বলা হয় ভাষায় প্রকাশিত যুক্তিপদ্ধতি বা অনুমান সম্বন্ধীয় বিজ্ঞান। 

যুক্তিবিদ্যার মূল বিষয় হলো অনুমান। অনুমান হলো জানা বিষয় থেকে অজানা বিষয় সম্পর্কে ধারণা লাভের মানসিক প্রক্রিয়া। যেমন, দূরে কোথাও ধোঁয়া দেখলে আমরা অনুমান করতে পারি যে সেখানে আগুণ লেগেছে। এখানে ধোঁয়া হলো জানা বিষয় আর আগুণ লাগা হলো অজানা বিষয় বা অনুমান।

যুক্তিবিদদের দৃষ্টিতে যুক্তি কি?

যুক্তিবিদ মিলের মতে,

যুক্তিবিদ্যা হচ্ছে এমন একটি বিজ্ঞান যা সাক্ষ্য বা প্রমাণের বিচার দ্বারা জ্ঞাত সত্য থেকে অজ্ঞাত সত্যে উপনীত হওয়ার জন্য যে বোধশক্তি ক্রিয়ার প্রয়োজন হয় সে সম্পর্কে আলোচনা করে বোধশক্তির ক্রিয়াকে সাহায্য করে এমন কতগুলো প্রক্রিয়া সম্পর্কে আলোচনা করা।[1]যুক্তিবিদ্যা সাধারণ ও প্রতীকী; পৃষ্টা নং; ২

যুক্তিবিদ্যা হচ্ছে ভাষায় প্রকাশিত চিন্তা সম্বন্ধীয় বিজ্ঞান যা সঠিকভাবে চিন্তা করার নিয়মগুলো নির্দেশ করে এবং কীভাবে সে নিয়মগুলোকে অনুসরণ করে আমাদের চিন্তাকে যথার্থ করা যায় এবং সত্যতা লাভ করা যায় সে সম্পর্কে জ্ঞান দান করে। [2]যুক্তিবিদ্যা সাধারণ ও প্রতীকী; পৃষ্টা নং; ২ 

যুক্তিবিদ্যায় যুক্তি বলতে বুঝানো হয়- যুক্তি হচ্ছে এমন এক বাক্যের সমষ্টি যেখানে একটি বাক্য অন্য বাক্য থেকে নিঃসৃত হয় এবং ঐ বাক্যগুলোই নিঃসৃত বাক্যের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। যেমন, 

আশ্রয় বাক্যঃ সকল দার্শনিক হলো জ্ঞানী। 

আশ্রয় বাক্যঃ ইমাম গাজালি একজন দার্শনিক। 

সিদ্ধান্তঃ  সুতরাং ইমাম গাজালি একজন জ্ঞানী। 

এখানে সিদ্ধান্তটি উপরের দুটি বাক্য থেকে নিঃসৃত হয়েছে। তবে নিছক কতগুলো বাক্য মিলে কিন্তু যুক্তি যুক্তি গঠিত হয়না। যুক্তির কিছু নিজস্ব নিয়ম রয়েছে। এক্ষেত্রে  আশ্রয় বাক্য (Premises) ও সিদ্ধান্ত (Conclusion) সম্পর্কে জানতে হবে। 

আশ্রয় বাক্য হলো একটি বাক্য যুক্তিতে ব্যাবহার হয়ে সিদ্ধান্তের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে তখনই তাকে আশ্রয় বাক্য বলে। অন্যদিকে, সিদ্ধান্ত হচ্ছে একটা বাক্য যখন আশ্র্যয় বাক্য অনিবার্যভাবে থেকে নিঃসৃত হয় তখন তাকে সিদ্ধান্ত বলে।

উপরে যে উদাহারণটি আমরা দিয়েছিলাম তা আবার লক্ষ্য করুন।

আশ্রয় বাক্যঃ সকল দার্শনিক হলো জ্ঞানী। 

আশ্রয় বাক্যঃ ইমাম গাজালি একজন দার্শনিক। 

সিদ্ধান্তঃ  সুতরাং ইমাম গাজালি একজন জ্ঞানী। 

এখানে আশ্রয় বাক্যগুলো থেকেই সিদ্ধান্ত এসেছে। অর্থাৎ এই বাক্যগুলো সিদ্ধান্তের ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। অন্যদিকে, সিদ্ধান্ত বাক্যটি অনিবার্যভাবেই নিঃসৃত হয়েছে। কারণ এখানে ‘ইমাম গাজালি একজন জ্ঞানী’ এটার পরিবর্তে ‘পাখিরা আকাশের উড়ে’ এটা বলা যাবেনা।  

যুক্তিকে দুইভাগে ভাগ করা যায়। যেমন, ১. অবরোহী (Deductive) 2. আরোহী (Inductive) 

অবরোহী (Deductive)

যে যুক্তিতে সিদ্ধান্ত এক বা একাধিক যুক্তিবাক্য থেকে অনিবার্যভাবে নিঃসৃত হয় এবং সিদ্ধান্ত কখনোই যুক্তি বাক্য থেকে ব্যাপকতর হতে পারেনা; সেই যুক্তিকে অবরোহ যুক্তি বা অনুমান বলে।

যেমন;  

আশ্রয় বাক্যঃ সকল মানুষ হয় মরণশীল।

আশ্রয় বাক্যঃ মিস্টার রহিম একজন মানুষ।

আশ্রয় বাক্যঃ সুতরাং, মিস্টার রহিম মরণশীল।

এখানে যুক্তি বাক্য থেকে সিদ্ধান্ত অনিবার্যভাবে নিঃসৃত হয়েছে এবং সিদ্ধান্ত যুক্তিবাক্য থেকে ব্যাপকতর নয়। অর্থাৎ, এই যুক্তি বাক্য বা প্রেমিসগুলো থেকে সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র “মিস্টার রহিম মরণশীল” এটাই আসবে অন্য কিছু আসবেনা। এই যুক্তিতে যেহেতু আশ্রয় বাক্যের সাথে সিদ্ধান্তের একটা অনিবার্য সম্পর্ক রয়েছে তাই যুক্তি বাক্য যদি সত্য হয় তাহলে সিদ্ধান্ত সত্য বা বৈধ হতে বাধ্য। এবং যুক্তিবাক্য যদি মিথ্যা হয় তাহলে সিদ্ধান্ত মিথ্যা বা অবৈধ হতে বাধ্য।

আরোহী (Inductive) 

যে অনুমানে বিশেষ বিশেষ দৃষ্টান্তের পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে একটি সার্বিক সংশ্লেষক যুক্তিবাক্য গঠন করা হয় তাকে আরোহ যুক্তি বা অনুমান বলে। যেমন; 

আশ্রয় বাক্যঃ এশিয়ার সব রাজহাঁস সাদা

আশ্রয় বাক্যঃ আমেরিকার সব রাজহাঁস সাদা

আশ্রয় বাক্যঃ  ইউরোপের সব রাজহাঁস সাদা

সিদ্ধান্তঃ পৃথিবীর সকল রাজহাঁস সাদা। 

এখানে আমরা এশিয়া, আমেরিকা এবং ইউরোপের রাজহাঁসগুলো পর্যবেক্ষণ করেছি, পৃথিবীর সকল রাজহাঁস নয়। অর্থাৎ, আমরা বিশেষ বিশেষ দৃষ্টনান্তের পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি যে সেগুলো সব সাদা। এবং এই বিশেষ বিশেষ পর্যবেক্ষনের উপর ভিত্তী করেই আমরা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে পৃথিবীর সকল রাজহাঁস সাদা। এই যুক্তিগুলোর ক্ষেত্রে শতভাগ নিশ্চয়তা দেওয়া যায়না। কারণ পর্যবেক্ষণ পরিবর্তন হলে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হবে। তাই এই যুক্তিগুলো সম্ভাবনামূলক। আমরা যদি কখনোই কালো বা অন্য কোনো রঙ এর রাজহাঁস দেখতে পায় তাহলে আমাদের সিদ্ধান্ত মিথ্যা হবে। 

যুক্তি বা চিন্তা কি অপেক্ষিক নাকি ব্যক্তিনিরপেক্ষ?

যুক্তি আপেক্ষিক নাকি ব্যক্তিনিরপেক্ষ এই প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করছে আপনি কোন প্রসঙ্গে এটি বিবেচনা করছেন তার উপর।

যখন কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য যৌক্তিক নীতিগুলি প্রয়োগ করা হয়, তখন তা ব্যক্তিনিরপেক্ষ। যেমন, যুক্তিবিদ্যার মৌলিক নিয়ম (Law of Identity, Law of Non-Contradiction, Law of the Excluded Middle) এছাড়াও কার্য-কারণ সম্বন্ধ, এই বিষয়গুলো ব্যক্তিনিরপেক্ষ হিসাবে বিবেচিত হবে। কারণ এই নিয়মগুলো ব্যক্তিগত অনুভূতি, ব্যাখ্যা বা পক্ষপাতের উপর নির্ভর করে না।

অন্যদিকে যুক্তি তৌরি করার জন্য যে উপাদানগুলোর প্রয়োজন হয় যেমন, অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, এবং প্রেমিসের গঠনের মতো বিষয়গুলো ব্যক্তিগত অনুভূতি, ব্যাখ্যা বা পক্ষপাতের উপর নির্ভর করে। তাই এক্ষেত্রে আমরা যুক্তিকে ব্যক্তিনিরপেক্ষ বলতে পারি না।

এই ক্যাটাগরির অন্যান্য লেখা পড়ুনঃ [3]ফিলোসফি – Faith and Theology (faith-and-theology.com)

আমাদের ফেইসবুকঃ [4](1) Facebook

 

References

References
1 যুক্তিবিদ্যা সাধারণ ও প্রতীকী; পৃষ্টা নং; ২
2 যুক্তিবিদ্যা সাধারণ ও প্রতীকী; পৃষ্টা নং; ২
3 ফিলোসফি – Faith and Theology (faith-and-theology.com)
4 (1) Facebook

Sazzatul Mowla Shanto

As-salamu alaykum. I'm Sazzatul mowla Shanto. Try to learn and write about theology and philosophy.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button