Trending

স্রষ্টার মৃত্যু এবং শূন্যতার অভিশাপ!

ফিলোসোফি

স্রষ্টার মৃত্যু এবং শূন্যতার অভিশাপ

নৈরাশ্যবাদ বা ধ্বংসবাদের প্রবক্তা ফ্রেডরিখ নীটশে তার দ্যা গে সাইন্স এবং দাস স্পোক জরাথুস্ত্রা গ্রন্থে ঈশ্বরের মৃত্যু ঘোষণা করেছেন এক পাগলের মাধ্যমে। পাগলটি উজ্জ্বল ভোরে সেই একটি লণ্ঠন জ্বালান, ক্রন্দনরত হয়ে বাজারের কাছে গিয়ে চিৎকার করে বলতেন, ❝ আমি ঈশ্বরকে খুঁজছি! আমি ঈশ্বরকে খুঁজছি!’ যারা ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস রাখে না তাদের অনেকেই তখন দাঁড়িয়ে মজা নিচ্ছিল। তারা প্রশ্ন করছিল, ঈশ্বরকে তুমি হারালে তা হলে? নিখোঁজ শিশুর মতো হারিয়েছেন ঈশ্বর? নাকি গোপন কোথাও লুকিয়ে আছেন?আমাদের ভয়ে তিনি কি তাহলে ভীত? ঈশ্বর কি সমুদ্রযাত্রায় বেরিয়েছেন নাকি তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন?

পাগলটি সবার মাঝখানে চলে যায়। সে বলে, ঈশ্বর কোথায়, আমি তোমাদের বলছি। ঈশ্বর মৃত, মৃতই থাকবে। এবং আমরা তাকে হত্যা করেছি। আমরা কিভাবে নিজেদের সান্ত্বনা দেব, সব খুনিদের খুনি? আমাদের ছুরির নিচে রক্ত ​​ঝরেছে যা পৃথিবীর মালিকানায় সবচেয়ে পবিত্র এবং শক্তিশালীর ছিল: কে আমাদের এই রক্ত ​​মুছে দেবে? আমাদের নিজেদের পরিষ্কার করার জন্য কি জল রয়েছে? ❞

অনেকেই ভেবে থাকেন নীটশে নাস্তিকতার পক্ষে কিছু বলেছেন, বস্তুত তা কিন্তু নয়। নীটশে বলতে পারছেন না, ঈশ্বর বলতে কিছু নেই। রূপকে বলছেন, ঈশ্বরের মৃত্যুর কথা। কিন্তু আক্ষরিকভাবে মারা গেছেন, তাও বলতে পারছেন না। কারণ সত্যিই তিনি মারা গেলে এর আগ অবধি তিনি বেঁচে ছিলেন। কিন্তু ঈশ্বরের বেঁচে থাকা মানলে এটি মানতে হয় যে, ঈশ্বর অবিনশ্বর। কারণ খ্রিষ্টীয় বিশ্বাসে ঈশ্বরের মৃত্যু নেই!

তার মানে, ঈশ্বর মারা গেছেন ঘোষণা ঈশ্বরের অস্তিত্বহীনতা বোঝায় না। ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস হারানোর বিষয়টিই স্পষ্ট করে। এই বিশ্বাস হারানোতে নীটশে খুশি ছিলেন না। বড় বেদনায় তিনি প্রকাশ করেন একে। ঘোষণাটি তিনি প্রদান করেন এক পাগলের কণ্ঠে। ষোড়শ শতকের শুরুতে যে বৈজ্ঞানিক বিপ্লব শুরু হয়েছিল সেটি প্রাকৃতিক ঘটনাকে বোঝার এমন উপায় প্রস্তাব করে, যাকে চার্চের প্রচলিত ধর্মীয় নীতি বা ধর্মগ্রন্থের রেফারেন্স দ্বারা প্রকৃতি বোঝার চেষ্টা থেকে স্পষ্টভাবে উচ্চতর মনে করা হচ্ছিল। পরবর্তী শতকগুলোতে বিজ্ঞান, শিল্পায়ন ও বর্ধমান প্রযুক্তিগত ক্ষমতা মানুষকে প্রকৃতির ওপর অধিক নিয়ন্ত্রণের অনুভূতি প্রদান করে। এ যাত্রায় চার্চ সহায়তা করতে পারেনি। চার্চের একাধিপত্যের দিন শেষ করে দেয় রেনেসাঁ। যে খোদার নাম করে জ্ঞান-বিজ্ঞান, মুক্তি-স্বাধীনতা, সাম্য-মানবাধিকার প্রভৃতির পথে দেয়াল খাড়া করা হয়েছিল, নতুন ইউরোপ সেই দেয়াল ভাঙতে গিয়ে চার্চের ঈশ্বরকেও ভাঙল। কেউ তাকে করল গৃহবন্দী, কেউকরল প্রত্যাখ্যান; চাইল তার মরণ। ঈশ্বরকে ছেড়ে বিজ্ঞান, যুক্তিবাদ, শিল্প ও পুঁজিকে ঈশ্বর বানিয়ে আধুনিক বুদ্ধিবৃত্তির নায়করা এগিয়ে চলছিলেন। সেখানে সাধারণত খ্রিষ্টবাদের ঈশ্বর হয়েছিলেন অবাঞ্ছিত, নয় মৃত। ঈশ্বরের প্রতি অনাস্থা থেকেই এ অনাস্থার সৃষ্টি, তা বলা যাবে না এককথায়। এ অনাস্থার অন্যতম কারণ ছিল সেইসব শ্রেণী ও প্রতিষ্ঠান, যারা নিজেদের ঈশ্বরের প্রতিনিধি বলে দাবি করত। তাদের কাছে জীবনের নানা সঙ্কটের সমাধান আছে, সেটি বিশ্বাসযোগ্যভাবে তারা পেশ করতে পারেনি। যে কারণে নীটশে খ্রিষ্টীয় ঈশ্বরকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করেছেন। কিন্তু ঈশ্বরকে হারানোর ফলে পশ্চিমা জীবনে বিরাট শূন্যতা আসবে, বস্তুঈশ্বর যা পূরণ করার ক্ষমতা রাখে না। নীটশে তা লক্ষ করেছিলেন। তিনি সতর্ক করেন, এ শূন্যতা হবে অশুভ, সর্বগ্রাসী, ধ্বংসাত্মক। নানা বিশ্বাস, ধারণা ও নীতি জন্ম নেবে একে পূরণ করতে। কিন্তু এগুলোকেও গ্রাস করবে বিরাট সেই শূন্যতা। শেষ অবধি জীবন বিঘ্নিত হবে নির্মমতায়, যুদ্ধে, সন্ত্রাসে।

 

ঈশ্বরকে হারালে শুন্যতার অভিশাপ গ্রাস করবেই। যেমন আক্ষরিক অর্থে নাস্তিকতার অর্থ হচ্ছে মরো। আমাদের বেচে থাকার কোন উদ্দেশ্য নেই। নাস্তিকীয় দর্শনে কোনোকিছু পরম ভালো বা মন্দ বলে নির্ধারণ করা যায় না। কারণ এক্ষেত্রে একটি স্ট্যান্ডার্ড বা মানদণ্ডের দরকার হয়। নাস্তিকদের ক্ষেত্রে এমন কোনো মানদণ্ড নেই—তাদের কারও কাছে মানদণ্ড হলো বিবেক, কারও কাছে সমাজের চল; এসবই পুরোপুরি আপেক্ষিক। এক সময়ে যা ভালো, অন্য সময়ে তা খারাপ হয়ে যায়; এক সমাজে যা ভালো অন্য সমাজে তা মন্দ বলে নিন্দিত হতে পারে। তাই বস্তুবাদী দর্শনে মূলত ভালো-মন্দ বলে কিছু নেই। স্রষ্টার অনুপস্থিতিতে কারও ভালো হতে চাওয়ার কোনো ভিত্তি নেই। স্যাপিয়েন্স পড়তে গিয়ে দেখি, নাস্তিক ইউভাল নোয়াহ হারারি বলেছেন :

 

মহাবিশ্বে কোনো দেবদেবী নেই, জাতি বলতে কিছু নেই, নেই কোনো অর্থকড়ি, টাকাপয়সা, মানবাধিকার বলে কিছু নেই, আর নেই কোনো আইন ও সুবিচার। এগুলো কেবল মানুষের সমষ্টিগত কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয় । [1]YUVAL NOAH HARARI, SAPIENCE: A BIEF HSTORY OF HUMANKIND; P. 31

 

অর্থাৎ স্রষ্টার অস্তিত্ব না থাকলে ভালো-মন্দ নিয়ে নিশ্চিত জাজমেন্ট দেয়ার চেষ্টা অর্থহীন। তথাকথিত মানবতাবাদিদের মানবাধিকারের বুলি, আইন-সুবিচারের ধারণা, ভালো/মন্দের কথকতা এগুলো সব কল্পনা। বেঁচে থাকা ও বংশবৃদ্ধির সুবিধার জন্য মানুষ এসব বানিয়েছে। যদি শুধু প্রকৃতিই সবকিছু হয় তাহলে ভালো যেমন অর্থহীন, মন্দও তেমনই অর্থহীন।

নোবেলজয়ী দার্শনিক জ্যাঁ পল সারত্রে’র উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র ফরাসি লেখক এন্টোনি রোকুয়েন্টিন-এর ভাষায় বললে,

কথা কিন্তু সত্যি। আমি এমনটিই বুঝতে পেরেছি যে আমার বেঁচে থাকার কোনই অধিকার নেই। (বস্তুবাদ অনুযায়ী) আমার অস্তিত্ব ঘটেছে আকস্মিকভাবে। আমি মানুষ না হয়ে পাথত, গাছ কিংবা জীবাণু হিসেবে অস্তিত্বলাভ করতে পারতাম।… আমি চিন্তা করছিলাম… এই যে আমরা এই পৃথিবীতে খানাপিনা করে বেড়াচ্ছি আমাদের মূল্যবান অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য। কিন্তু এ বেঁচে থাকার তো কোন কারণই নেই, একদম না। [2]JEAN PAUL SARTRE, NAUSEA. P. 162

 

 

 

References

References
1 YUVAL NOAH HARARI, SAPIENCE: A BIEF HSTORY OF HUMANKIND; P. 31
2 JEAN PAUL SARTRE, NAUSEA. P. 162

Asief Mehedi

Assalamualaikum to all.My name is Asief Mehedi . I am an informal philosophy student. Let's talk about comparative theology, we work to suppress atheism. Help us to suppress atheism and come forward to establish peace.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button