হিলবার্ট হোটেল প্যারাডক্স

হিলবার্ট এর ইনফিনিটি হোটেল প্যারাডক্স বা হিলবার্ট প্রবলেম

হিলবার্ট হোটেল প্যারাডক্স

আপনাকে যদি প্রশ্ন করা হয়, ১ থেকে ৫ এর মধ্যে কয়টি সংখ্যা রয়েছে? সাবলীল ভাবেই আপনি উত্তর দিবেন ৫টি। কিন্তু যদি বলি আপনার উত্তর ভুল, তখন আপনার প্রতিক্রিয়া কেমন হবে? হয়তো বলবেন আমি নিশ্চয় পাগল হয়ে গিয়েছি। তবে আসলেই আপনার উত্তর পুরোপুরো সঠিক নয়। কারণ সংখ্যারেখার দিকে তাকালে দেখবেন এই ১ থেকে ৫এর মাঝে আরো অগণিত সংখ্যা রয়েছে, যা আপনি গুণে শেষ করতে পারবেন না। এই অসীমত্বকে কাজে লাগিয়ে জার্মান গণিতবিদ ডেভিড হিলবার্ট একটি প্যারাডক্স তৌরি করেন যা, Hilbert’s Infinite Grand Hotel Paradox বা হিলবার্ট প্রবলেম নামে পরিচিত।

গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড ২০০৮ এর তথ্য মতে, কক্ষের উপর ভিত্তি করে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হোটেল হলো মালেশিয়ার “ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড হোটেল”। “মালেশিয়ার লাস ভেগাস” নামে পরিচিত এই হোটেলটির কক্ষ সংখ্যা ৬,১১৮টি। ধরুন, হোটেলের প্রতিটি কক্ষে ১জন করে গেস্ট থাকতে পারে। এর মানে যদি হোটেলের ৬,১১৮টি কক্ষ গেস্ট দ্বারা পূর্ণ থাকে, তাহলে হোটেলে ম্যানেজার চাইলে নতুন কোনো গেস্টকে চেক ইন করতে পারবেনা; যদিনা কোনো গেস্ট চেক আউট করে ৬,১১৭ বা তার চেয়ে কম হয়।

কিন্তু হিলবার্ট হোটেল পুরোপুরি আলাদা। এটি “মালেশিয়ার ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড হোটেল” বা মালেশিয়ার লাস ভেগাস” নামে পরিচিত হোটেলটির চাইতে অসীমভাবে বড়। বিষয়টা এমন নয় যে এটি অনেক অনেক বড়। বরং অসীমভাবে বড়। এমনও নয় যে হিলবার্ট হোটেলে ১হাজার, ১মিলিয়ন, ১ট্রিলিয়ন রুম রয়েছে। এখানে অসীম সংখ্যক রুম রয়েছে।

একদিন হোটেলে নতুন একজন গেস্ট এসে হোটেল ম্যানেজারকে বললো তার একটা রুমের প্রয়োজন। এমত অবস্থায় আপনি হলে কি করতেন? নিশ্চয় নতুন আসা গেস্টকে হোটেলে রুম খালি নেই বলে বিদায় করে দিতেন! কিন্তু হিলবার্ট হোটেলের ম্যানেজার ছিলো একজন গণিতবিদ। তিনি চিন্তা করলেন, রুম-১ এর গেস্টকে রুম-২এ শিফট করলে, রুম-২এর গেস্টকে রুম-৩এ শিফট করলে, এভাবে nতম রুমের গেস্টকে n+1তম রুমে শিফট করলে এবং এই প্রক্রিয়া অসীম সংখ্যকবার চলতে থাকলে একটি রুম ফাঁকা হয়ে যাবে। কারণ হিলবার্ট হোটেলের রুম সংখ্যা যেহেতু অসীম সেহেতু গেস্টদের এই মুভমেন্টও অসীম সংখ্যকবার চলতে থাকবে। এভাবে হোটেল ম্যানেজার নতুন আসা গেস্টকে চেক ইন করিয়ে নিলেন। নতুন গেস্ট চেক ইন করার আগেও হোটেলের গেস্ট সংখ্যা ছিলো অসীম। বর্তমানেও হোটেলের গেস্ট সংখ্যা হচ্ছে অসীম। কারণ, অসীমের সাথে অসীম যোগ করলেই ফলাফল অসীমই হবে।

পরদিন সকালে হোটেলে অসীম সংখ্যক অতিথি নিয়ে একটি বাস আসলো। এবং অসীম সংখ্যক অতিথির জন্যও অসীম সংখ্যক রুমের প্রয়োজন। হোটেল ম্যানাজের যেহেতু একজন তুখোড় গণিতবিদ, তাকে তো অথিতিদের জায়াগা করে দিতেই হবে। তিনি চিন্তা করলেন, যেকোনো সংখ্যাকে ২ দিয়ে গুণ করা হলে সবসময়ই জোড় সংখ্যা পাওয়া যাবে। তাহলে nকে যদি ২দিয়ে গুণ করা হয় তাহলে ফলাফল হবে 2n, তাহলে প্রতিটা রুমের পর্যটক তাদের রুমের সাথে ২গুণ করে যে সংখ্যাটি পাওয়া যাবে সেই রুমে শিফট করলে অসীম সংখ্যক রুম ফাঁকা হয়ে যাবে।

তাই হোটেল ম্যানেজের ১নং রুমে থাকা অতিথিকে রুম-২এ, ২নং রুমে থাকা অতিথিকে রুম-৪এ, ৩নং রুমে থাকা অতিথিকে রুম-৬এ, এভাবে nতম রুমের অতিথিকে 2nতম রুমে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। ফলে হোটেলে অসীম সংখ্যক রুম ফাঁকা হয়ে গেল। কারণ, হোটেলে রুম সংখ্যা যেহেতু অসীম, তাই হোটেলের জোড় সংখ্যক রুমও অসীম এবং বিজোড় সংখ্যক রুমও অসীম। এভাবে হোটেল ম্যানেজার নতুন আসা অসীম সংখ্যক অতিথিকে হোটেলের খালি হওয়া বিজোড় সংখ্যার রুমগুলোতে যেতে বলেন। ব্যাস, ঝামেলা শেষ!

কিন্ত এবার পরেরদিন সকালে অসীম সংখ্যক বাস এবং অসীম সংখ্যক বাসের প্রত্যেকটিতে অসীম সংখ্যক যাত্রী রয়েছে। হোটেল ম্যানেজার দুশ্চিন্তায় পরে গেল কিভাবে এতো এতো অতিথিকে হোটেলে রুমের ব্যাবস্থা করে দিবেন! এমন সময় হোটেল ম্যানেজারের চোখ পরলো তার টেবিলে রাখা গণিতবিদ ইউক্লিডের ছবির দিকে। ইউক্লিড প্রমাণ করেছিলেন যে, মৌলিক সংখ্যার (যে সংখ্যাকে কেবল ১ ও সেই সংখ্যা দিয়ে ভাগ করা যায় তাকে মৌলিক সংখ্যা বলে। যেমন, ১,৩,৫,৭,১১,১৩…) সেট অসীম।

তাই হোটেল ম্যানেজার চিন্তা করলেন যদি, প্রথমে অসীম সংখ্যক রুম ফাঁকা করা যায়, তাহলে সেখানে একটা বাসের অসীম সংখ্যক অতিথিকে জায়গা করে দেওয়া যাবে। এরপর আরেকবার অসীম সংখ্যক রুম ফাঁকা করে সেখানে আরেকটি বাসের অসীম সংখক অতিথিদের জায়গা দেওয়া যাবে। এবং এভাবে অসীম সংখ্যকবার করে গেলে তাহলে অসীম সংখক বাসের অসীম সংখ্যক যাত্রীকে হোটেলে জায়গা করে দেওয়া যাবে। এবং এই কাজটা অসীম সংখ্যকবার করতে হবে। তাই হোটেল ম্যানেজার বর্তমানে হোটেলে থাকা সব অতিথিদের প্রথম মৌলিক সংখ্যা ২এর ঘাত অনুযায়ী শিফটড হওয়ার জন্য নির্দেশ দিলেন। অর্থাৎ, ২নং রুমের অতিথিকে 2^2=4 নং রুমে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। ৩নং রুমের অতিথিকে 2^3=8 নং রুমে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। ৪নং রুমের অতিথিকে 2^4=16 নং রুমে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। সুতরাং nতম রুমের অতিথি যাবেন 2^nতম রুমে। এভাবে হোটেলে অসীম সংখ্যক রুম ফাঁকা হয়ে গেল। সুতরাং, হোটেলে অবস্থানরত সব অতিথি চলে যাবে প্রথম মৌলিক বা প্রাইম নাম্বার ২এর ঘাত অনুযায়ী রুমে।

তাহলে নতুন করে আসা অসীম সংখ্যক বাসের অসীম অতিথিরা কোথায় যাবে?

প্রথম বাসের অতিথিদের বললেন দ্বিতীয় মৌলিক পূর্ণ সংখ্যা ৩এর ঘাত অনুযায়ী রুমে যাবে। অর্থাৎ, বাসের প্রথম সিটের অতিথি যাবে 3^1=3 নং রুমে। দ্বিতীয় সিটের অতিথি যাবে 3^2=9 নং রুমে। তৃতীয় সিটের অতিথি যাবে 3^3=27 নং রুমে। চতুর্থ সিটের অতিথি যাবে 3^4=81 নং রুমে। nতম রুমের অতিথি যাবে 3^nতম রুমে। এভাবে তিনের ঘাত আমরা অসীম সংখ্যকবার করতে পারবো।

একইভাবে, ২য় বাসের অতিথিদের ৫এর ঘাত অনুযায়ী হোটেল রুমে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। ৩য় বাসের অতিথিদের ৭এর ঘাত, ৪র্থ বাসের অতিথিদের ১১এর ঘাত ৫নং বাসের অতিথিদের ১৩এর ঘাত অনুযায়ী হোটেল রুমে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন……..। এভাবেই হোটেল ম্যানেজার অসীম সংখ্যক বাসের অসীম সংখ্যক অতিথিদের হোটেলে জায়গা করে দিলেন। যাদিও এই অসীম সংখ্যক অতিথিকে হোটেলে যায়গা করে দেওয়ার আগেই হোটলের অতিথি সংখ্যা ছিলো অসীম।

এবার প্রথম সিচুয়েশনটি কল্পনা করুন। হোটেল ম্যানেজার অসীম সংখ্যক রুম পূর্ণ হোটেলে একজন নতুন অতিথিকে জায়গা করে দিয়েছিলো। যদি সেখান থেকে অসীম সংখ্যক অতিথিকে বিয়োগ করা হয় তাহলে ফলাফল হবে ১জন। ধরুন, অসীম সংখ্যক অতিথি হচ্ছে x1 এখন নতুন ১জন অতিথি আসার পরে হোটেলের বর্তমান অতিথি সংখ্যাও অসীম। তাহলে এখন অসীম সমানও ধরুন X1 তাহলে এখন যদি x থেকে x বিয়োগ করেন তাহলে ফলাফল হবে x-x= 1.

এবার দ্বিতীয় সিচুয়েশনটি কল্পনা করুন, হোটেল ম্যানেরজার অসীম বিজোড় সংখ্যক রুম ফাঁকা করে অসীম সংখ্যক অতিথিকে জায়গা করে দিয়েছিল। তার মানে তখনো হোটেলে অসীম জোড় সংখ্যক অতিথি ছিলো।

যদি হোটেল থেকে জোড় সংখ্যক অতিথি চেকাউট করে তাহলে কি হবে? ধরুন জোড় সংখ্যক অসীম = x এবং বিজোড় সংখ্যক অসীম = x. তাহলে, x-x=x. কারণ জোড় সংখ্যক অসীম থেকে বিজোড় সংখ্যক অসীম বাদ দেওয়ার পরেও জোড় সংখ্যক অসীম থেকেই যাচ্ছে। যদিও অসীম সংখ্যক অতিথি চেকাআউট করেছে।

এবার তৃতীয় সিচুয়েশনটি কল্পনা করুন। মৌলিক সংখ্যা আছে যেহেতু অসীম সেহেতু হোটেলটি পূর্ণ অবস্থায় হোটেল ম্যানেজার অসীম সংখ্যক নতুন গেস্টকে হোটেলে জায়গা করে দিয়েছেন। সুতরাং আবারো অসীম থেকে অসীম বিয়োগ করলে ফলাফল হবে অসীম। x-x=x.

এই এনালজিতে দেখা যাচ্ছে যে, Identical Quantity – Identical Quantity = Different Result!

কারণ, আপনি যদি দুই থেকে দুই বিয়োগ করেন তাহলে প্রতিবারই ফলাফল আসবে শূন্য। কখনোই ফলাফল শূন্য ছাড়া অন্য কিছু হবেনা। কিন্তু ইনফিনিটির ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাচ্ছি ইনফিনিটি থেকে বিয়োগ করলে একেকবার একেক ফলাফল আসে। অর্থাৎ, এটা কন্ট্রাডিকশনমূলক এবং মেটাফিজিক্যালি নেসেসারি ট্রুথ কে ভায়োলেট করে। ইনফিনিট হোটেল পূর্ণ থাকার পরেও হোটেলে নতুন মানুষকে জায়গায় করে দেওয়া যাচ্ছে, যা পুরোপুরো অযৌক্তিক। কেননা রুম আগে থেকেই পূর্ণ ছিলো। অর্থাৎ একই সাথে একই সময়ে খালি এবং পূর্ণ। আবার আইডেন্টিক্যাল কোয়ান্টিটি বাদ দিলে আমরা ভিন্ন ভিন্ন ফলাফল পাচ্ছি যা কন্ট্রাডিকশন তৌরি করে।

সুতরাং যা কিছু মেটাফিজিক্যাল নেসেসারি ট্রুথকে ভায়োলেশন করে তার অস্তিত্ব থাকা পসিবল না। ইনফিনিটি মেটাফিজিক্যাল নেসেসারিকে ভায়োলেশন করে, তাই ইনফিনিটি অস্তিত্বে থাকতে পারেনা। হিলবার্ট হোটেলের এই অযৌক্তিকতা আমাদের এটা দেখায় যে ইনফিনিটি কেবলমাত্র গাণিতিক ধারণা এবং এটাকে আমরা বাস্তব জীবনে উপলব্ধি করতে পারিনা।

ফেইসবুকঃ Faith & Theology | Facebook

Home – Faith and Theology (faith-and-theology.com)

Sazzatul Mowla Shanto

As-salamu alaykum. I'm Sazzatul mowla Shanto. Try to learn and write about theology and philosophy.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button