পবিত্র কুরআনে সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্ব

পবিত্র কুরআনে সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্ব

পবিত্র কুরআন কোনো বৈজ্ঞানিক গ্রন্থ না হলেও এখানে বৈজ্ঞানিক অনেক নিদর্শন রয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্ব সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের নিদর্শন। এই বিষয়ে আলোচনা করার পূর্বে একটি বিষয় সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা দেওয়া প্রয়োজন যে, একজন মুসলিম হিসেবে আমাদের কখনোই উচিত নয় যে বিজ্ঞানের আলোকে পবিত্র কুরআনকে ব্যখ্যা বা বিচার বিশ্লেষণ করা। বরং কুরআনের আলোকে বিজ্ঞানকে ব্যাখ্যা করা উচিত। কারণ বিজ্ঞান আমাদের পরম কোনো সত্য বা নিশ্চিত সত্য সম্পর্কে জ্ঞান দিতে পারেনা। বিজ্ঞানের সাথে কুরআনের কোনো জায়গায় সাঙ্গর্ষিকতা থাকলে কুরআন ভুল প্রমাণিত হয়ে যায়না। কারণ বিজ্ঞান পরিবর্তনশীল। বিজ্ঞান আজ যেটাকে সত্য বলছে কাল সেটাকে মিথ্যাও বলতে পারে। এই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে পড়ুন; বিজ্ঞানের দর্শন। [1]https://faith-and-theology.com//বিজ্ঞানের-দর্শন/ এবার মূল আলোচনায় আসা যাক। 

সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্ব কি? 

সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্ব অনুযায়ী দূরবর্তী ছায়াপথ সমূহের বেগ সামগ্রীক পর্যালোচনা করলে দেখা যায় এরা পরস্পর দূরে সরে যাচ্ছে। অর্থাৎ মহাবিশ্ব প্রতিনিয়ত সম্প্রসারণ হচ্ছে। Expansion theory বা সম্প্রসারণশীল তত্ত্ব সর্বপ্রথম প্রমাণ করেন বিজ্ঞানি হাবল। টেলিস্কোপের সাহায্যে তিনি লক্ষ্য করেন যে সূদূরের ছায়াপথ সমূহ (Galaxies) আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। হাবল পর্যবেক্ষণ করেন যে প্রতিটি গ্যলাক্সি আমাদের থেকে সমানুপাতিক হারে দূরে সরে যাচ্ছে। অর্থাৎ, গ্যালাক্সিগুলো ক্রমশই সম্প্রসারণ হচ্ছে। হাবল এটি আবিষ্কার করেন রেড লাইট শিফট ও ডফলার এফেক্টের মাধ্যমে। 

Red light Shift (রেড লাইট শিফট )

রেড লাইট শিফট দ্বারা আলোর তরঙ্গের কম্পাঙ্গের পরিবর্তন বর্ণনা করে। যা নির্ভর করে কোনো বস্তু আমাদের দিকে বা দূরে সরে যাচ্ছে। যখন কোনো বস্তু আমাদের থেকে দূরে সরে যায় তখন বস্তুর আলোকে রেড শিফট বলা হয়। সূর্যের বর্ণালিতে দৃশ্যমান আলোর পরিসীমা রয়েছে। সেখানে লাল আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ ৭০০ ন্যানো মিটার। এবং নীল আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ ৪০০ ন্যানো মিটার। লাল আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ বেশি হওয়ার কারণে আমরা বুঝতে পারি যে, যদি কোনো বস্তু থেকে লাল আলো বিকিরিত হলে সেই বস্তুটি আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। অর্থাৎ, কোনো গ্যলাক্সি যদি আমাদের কাছে আসতে থাকে তা হলে তা-থেকে নিঃসৃত আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ছোট হবে। যার ফলে গ্যালাক্সি যদি আমাদের কাছে আসতে থাকে তাহলে তা থেকে নীল আলোর দেখা মিলবে। একে বলে ব্লু-শিফট। 

অন্যদিকে, কোনো গ্যালাক্সি যদি আমাদের থেকে দূরে সরে যেতে থাকে তা-থেকে নিঃসৃত আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য বড় হতে থাকবে। যার ফলে, গ্যালাক্সি যদি আমাদের থেকে দূরে সরে যেতে থাকে তাহলে তা থেকে লাল আলোর দেখা মিলবে। যাকে বলে রেড-শিফট। হাবল V=hd সূত্রের সাহায্যে আবিষ্কার করেন যে, যে গ্যালাক্সির দূরত্ব যত বেশি সে গ্যালাক্সি তত বেশি বেগে একে অপর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে বা সম্প্রসারণ হচ্ছে। যার ফলে লাল আলো নিঃসৃত হয়। V=ভেগ, h= হাবল ধ্রুবক, d= দূরত্ব। 

Doppler Effect (ডপলার ক্রিয়া) 

উৎস এবং পর্যবেক্ষকের মধ্যকার আপেক্ষিক গতির কারণে কোন তরঙ্গ-সংকেতের কম্পাঙ্ক পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার ঘটনাকে ডপলার ক্রিয়া (Doppler Effect) বলা হয়। উদাহারণ স্বরূপ, আপনি ওয়াইফাই রাউটারের যত কাছে থাকবেন তত বেশি ফ্রিকোয়েন্সি গ্রহণ করতে পারবেন। 

আরেকটি উদাহারণ লক্ষ করুণ, এম্বুলেন্স রাস্তায় হর্ণ বাজিয়ে আপনার যতই কাছে আসবে ততই কম্পাঙ্ক বেশি হবে।  অর্থাৎ, উৎস কাছে আসলে কম্পাঙ্ক বাড়ে। এবং উৎস দূরে গেলে কম্পাঙ্ক কমে। 

কুরআনে সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্ব

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তালা বলেন, 

আমি আকাশ নির্মাণ করেছি আমার ক্ষমতা বলে এবং আমি অবশ্যই মহাসম্প্রসারণকারী। [2]সূরা আয-যারিয়াত; আয়াত-৪৭

পবিত্র কুরআনের এই আয়াতে “লামূছি’ঊন” এবং “ছামাআ” শব্দটি ব্যাবহার করা হয়ছে। “লামূছি’ঊন” শব্দের অর্থ “অবশ্যই মহাসম্প্রসারণকারী। [3]لموسعون In English – Translation and Meaning in English Arabic Dictionary of All terms Page 1 (almaany.com) [4]মোকাম্মাল লোগাতুল কুরআন; খন্ড;২ পৃষ্টা নংঃ ৫৪৪

“ছামাআ” শব্দের অর্থ আকাশ । আকাশ বলতে মূলত মহাবিশ্বকে বুঝানো হয়েছে। [5]Quran with Lughat; Android app.  

ঈমাম রাগেব (রঃ) তার বিখ্যাত মুফরাদাতুল কুরআনে লিখেছেন যে,

বস্তুর উপরিভাগ নিচের ভাগের তুলনায় ছামাআ। অর্থাৎ, ছামাআ বলতে বুঝানো হয় বস্তুর উপরের সবকিছু। আবার কেউ কেউ বলেছেন, সকল বস্তু তার নিচেরটির তুলনায় ছামাআ। অর্থাৎ, নিচের বস্তুর থেকে উপরের দিকের সবকিছু ছামাআ। [6]মোকাম্মাল লোগাতুল কুরআন; খন্ড;১ পৃষ্টা নংঃ ১৯  সুতরাং, সূরা আয-যারিয়াত এর ৪৭ নং আয়াতে ছামাআ শব্দদিয়ে নিচের বস্তু থেকে উপরের দিকের সবকিছুকে বুঝানো হয়ছে। সবকিছু বলতে মহাবিশ্বই।  

ইবনে খালদিয়া বলেছেন,

যে বস্তু তোমার থেকে উপরে তা হলো ছামাআ। [7]মুকাম্মাল লুগাতুল কুরআন

সামা শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘যা কিছু তোমার উপরে আছে’। [8]Definition – explanation and meaning of the sky in Arabic in Arabic dictionaries – the comprehensive dictionary of meanings – the intermediate dictionary – the contemporary … Continue reading অর্থাৎ, সামা শব্দের অর্থ উপরের সব কিছু বা পৃথিবী ব্যাতিত সবকিছু। অর্থাৎ মহাবিশ্ব। 

অনেক নাস্তিক তাদের বিভিন্ন ওয়েবসাইটে লিখেছে এই আয়াতে আকাশ বলতে মহাবিশ্বকে বুঝানো হয়নি। কিন্ত দুঃখের বিষয় তাদের সেই দাবীর পক্ষে একটা জাল রেফারেন্সও তারা উপস্থাপন করতে পারেনি। 

আল্লাহ কি “মূছি’ঊন” শব্দ দিয়ে সম্প্রসারণ করে ফেলেছেন বা অতীতকাল বুঝিয়েছেন?  

অনেক নাস্তিক তাদের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে দাবী করেছে যে আল্লাহ এই আয়াতে অতীত কাল বুঝিয়েছেন। অর্থাৎ আল্লাহ এই আয়াতে “মূছি’ঊন” শব্দ দিয়ে মহাবিশ্ব সম্প্রসারণশীল করে ফেলেছেন বুঝিয়েছেন কিন্তু বিজ্ঞান অনুযায়ী আমরা জানি যে মহাবিশ্ব এখনো সস্প্রসারণশীল হচ্ছে। 

সূরা আয-যারিয়াত৪৭ নং আয়াত এর কিছু অনুবাদ দেখা যাক।

Mustafa Khattab এর অনুবাদী বলা হয়েছে,

We built the universe with ˹great˺ might, and We are certainly expanding ˹it˺ 

এই অনুবাদে expanding শব্দটি ব্যাবহার করা হয়েছে। expanding শব্দটি দেখেই বুঝা আচ্ছে এটি একটি কন্টিনিউয়াস টেন্সে ব্যাবহার করা হয়েছে। ক্লাস সিক্সের ছাত্ররাও এটা জানে যে verb+ing হলে কন্টিনিউয়াস টেন্স হয়। 

তাফহিমুল কুরআন এর অনুবাদে বলা হয়েছে,

And heaven – We made it with Our Own Power and We have the power to do so.

এই অনুবাদে বলা হয়েছে আমরা (আল্লাহ) আমরা এটি তৌরি করেছি (সস্প্রসারণ করেছি) এবং আমাদের এটা করার ক্ষমতা আছে। অর্থাৎ আল্লাহ এখনো মহাবিশ্বকে ক্রমাগত সম্প্রসারণ করছে।

মুজিবুর রহমানের অনুবাদে,

আমি আকাশ নির্মাণ করেছি আমার ক্ষমতা বলে এবং আমি অবশ্যই মহাসম্প্রসারণকারী। 

উক্ত অনুবাদে মহাসস্প্রসারণকারী শব্দটি ব্যাবহার করেছে। পাঠক মহাসস্প্রসারণকারী শব্দ দিয়ে কি কোনোভাবেই অতীতকাল বুঝানো হয়?

Quran with Lugat এর অনুবাদ, 

With our power and strength, we have built the universe that is spread out in the cosmos. The expanse of our power has no boundaries. [9]Quran with Lughat; Android app.   

এই অনুবাদেও বলা হচ্ছে আল্লাহ তার ক্ষমতা দিয়ে মহাবিশ্ব তৌরি করছেন এবং এটিকে ছড়িয়ে দিয়েছেন বা সম্প্রসারণ করেছে। এই সম্প্রসারণ এর ক্ষমতার কোনো সীমা নেই। 

পাঠক এই অনুবাদগুলো থেকে স্পষ্টই বুঝা যায় যে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তালা এখানে কোনোভাবেই অতীত কালের কথা বলেনি। অর্থাৎ, আল্লাহ মহাবিশ্বকে সম্প্রসারণ করে ফেলেছেন এমনটি বলেননি। বরং সম্প্রসারণ করেছেন এবং তিনি এই সম্প্রসারণ করার ক্ষমতা রাখেন বা সম্প্রসারণ ক্ষমতার একমাত্র তারই রয়েছে। যেহেতু আমাদের মহাবিশ্ব ক্রমাগত সম্প্রসারণ হচ্ছে সেহেতু এই সম্প্রসারণ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তালাই করছেন। 

ব্যাকরণগত দিক থেকে 

আরবি ব্যাকরণ অনুযায়ী “ইন্না লামূছি’ঊন” শব্দটি একটি নামবাচক শব্দ বা Noun. আরবিতে নামবাচক শব্দ বা Noun Sentence ক্রমাগত বা চলমান অর্থ প্রকাশ করে।  সুতরাং মহাবিশ্ব যে সম্প্রসারণশীল হচ্ছে তা ক্রমাগত। 

আবার আরবি ব্যাকরণ অনুযায়ী বাক্য দুই ধরণের হয়ে থাকে। একটা Noun Sentence. অন্যটি Verbal Sentence.  Noun Sentence এর স্থায়িত্বকাল বেশি। যেমন মানুষ হয় মরণশীল। এটি একটা নাউন সেন্টেন্স। এখানে মানুষ মরণশীল এটা শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কোনো কালের কথা বুঝায়না। বরং অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সব কালকেই বুঝায়। 

অন্যদিকে Verbal Sentence এর স্থায়িত্বকাল কম। যেমন, আমি স্কুলে যায়।

সুতরাং, সন্দেহাতীতভাবেই এটা প্রমাণিত যে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তালা পবিত্র কুরআনে মহাবিশ্ব সম্প্রসারণশীলতার বিষয়ে ইঙ্গিত প্রধান করেছেন। 

 

References

Sazzatul Mowla Shanto

As-salamu alaykum. I'm Sazzatul mowla Shanto. Try to learn and write about theology and philosophy.

One Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button