স্রষ্টা এবং ব্যক্তিনিরপেক্ষ নৈতিকতা

স্রষ্টা এবং ব্যক্তিনিরপেক্ষ নৈতিকতা 

নৈতিকতা নিয়ে আলোচনা করার আগে আমাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে একটু আলোচনার প্রয়োজনবোধ করছি। আচ্ছা, আমরা কি অস্তিত্বে আছি? এর উত্তরে পৃথিবীর ৯৯% মানুষ হয়ত বলবে, ‘হুম, আমরা অস্তিত্বে আছি।’ বাকি ১% শতাংশ হয়ত বলবে, ‘না, আমরা আসলে অস্তিত্বে নেই। যেগুলো আমরা বাস্তব মনে করি এগুলো আসলে নিছক স্বপ্নের মায়াজাল ছাড়া আর কিছুই না।’ যদি আমাদের অস্তিত্ব থাকে তাহলে আমাদের নৈতিকতার প্রয়োজন আছে। আর আমাদের যদি অস্তিত্ব না থাকে তাহলে নৈতিকতার প্রয়োজন নেই। যদি আমাদের আসলেই অস্তিত্ব থাকে তাহলে প্রশ্ন আসবে, আমাদের অস্তিত্বের উদ্দেশ্য কি? এই অস্তিত্বের কোনো অর্থ আছে, নাকি নিরর্থক? যদি এই জীবন নিছক কোনো খেলনার পুতুল হয়, যার কোনো উদ্দেশ্য নেই, অর্থ নেই, তাহলে সে জীবনে নৈতিকতারও কোনো প্রয়োজন নেই। আর যদি জীবনের অর্থ থাকে তাহলে নৈতিকতারও প্রয়োজন আছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, নৈতিকতা আসলে কী? এবং নৈতিকতার উৎস কী?

নৈতিকতা হলো, সঠিক এবং ভুল বা ভাল এবং খারাপ আচরণের মধ্যে পার্থক্য সম্পর্কিত নীতিগুলি।[1]Definitions from Oxford Languages নৈতিকতার উৎস নিয়ে আলোচনা করতে গেলে দুটি বিষয় সামনে আসে তা হলো, ব্যক্তি নিরপেক্ষ (Objective) নৈতিকতা এবং আপেক্ষিক (Subjective) নৈতিকতা। ব্যক্তি নিরপেক্ষ নৈতিকতা বলতে বুঝানো হয়, এমন নৈতিক আদর্শ যা কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তি সমষ্টির চিন্তা-ভাবনা, বোধ-বিবেচনা অনুভূতির উপর নির্ভরশীল নয় রবং, স্বাধীন। অন্যদিকে, আপেক্ষিক নৈতিকতা হল এমন নৈতিক আদর্শ যা ব্যক্তিগত মতামত, ব্যক্তিগত বিশ্বাস, সাংস্কৃতিক নিয়ম এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটের উপর নির্ভরশীল।

নৈতিকতা ব্যক্তি নিরপেক্ষ নাকি আপেক্ষিক? 

নাস্তিকরা যেহেতু ব্যক্তি নিরপেক্ষ নৈতিকতাকে স্বীকার করতে চাইনা, তাই কিছু নাস্তিক মনে করে নৈতিকতা হলো আপেক্ষিক। অর্থাৎ, ব্যক্তি বা সমাজের মানুষই তাদের নৈতিকতা নির্ধারণ করবে। আমেরিকান নাস্তিকদের প্রেসিডেন্ট ডেভিড সিলভারম্যান বলেন,

ব্যক্তি নিরপেক্ষ নৈতিকতা বলতে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই। নৈতিকতা হলো আপেক্ষিক।[2] Frank Turek; Stealing from God Why Atheists Need God to Make Their Case; Chapter-4

অর্থাৎ, একজন ব্যক্তি নিজেই তার নৈতিকতা নির্ধারণ করবে। কাউকে ধর্ষণ করা, হত্যা করা, এটা নৈতিকভাবে ভালো নাকি খারাপ এ ব্যাপারে কেবল ব্যক্তি নিজেই সিদ্ধান্ত নিবে। এক্ষেত্রে আপনি কারো কাজকে ভুল বলতে পারবেন না। কাউকে ধর্ষণ করা আপনার নিকট ভুল মনে হলেও, যে এই কাজটি করেছে তার কাছে কিন্তু এই কাজ ভুল নয়। যেহেতু, ভালো এবং খারাপের মানদণ্ড হবে ব্যক্তি নিজেই, তাই ব্যক্তির নিকট যা ভালো মনে হবে তাই সে করবে। এমনটা হলে নৈতিকতার কোন অস্তিত্বই থাকেনা। কারণ, নৈতিকতা হলো ওই সকল নীতি যার মাধ্যমে আমরা সঠিক এবং ভুল বা ভাল এবং খারাপ আচরণের মধ্যে পার্থক্য করতে পারি। নৈতিকতা যদি আপেক্ষিক হয় তাহলে ভালো খারাপ বিষয়টাও আপেক্ষিক। একজনের কাছে যেটা ভালো অন্যের কাছে সেটা ভালো নাও হতে পারে। তাই প্রকৃত অর্থে চূড়ান্ত ভালো বা চূড়ান্ত খারাপ বলতে আসলে কিছুর অস্তিত্বই থাকবে না।

নৈতিকতা আপেক্ষিক হলে ধর্ষণ করা, চুরি-ডাকাতি, মানুষ হত্যা, এগুলা করা যাবে নাকি যাবেনা এটা কেবল মানুষের একান্ত মতামতের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। এখানে নৈতিক-অনৈতিকের কিছু নেই। আমরা ইতিমধ্যে যুক্তিবিদ্যার ‘যুক্তিবিদ্যার মৌলিক নীতি’ নিয়ে আলোচনা করেছি। যুক্তিবিদ্যার মৌলিক নিয়ম অনুযায়ী কোন কিছু একই সাথে বা একই সময়ে দুটি পরস্পর সাংঘর্ষিক অবস্থানে থাকতে পারেনা। যেমন, ‘ক’ সব সময়ের জন্য ‘ক’ হবে। ‘ক’ কখনোই ‘খ’ হবেনা বা ‘ক’ এর মধ্যে ‘ক’ না হওয়ার কোন সম্ভাবনা থাকবেনা। ঠিক একইভাবে, কোন একটা ঘটনা বা কাজ একই সাথে, একই সময়ে ভালো-অথবা খারাপ হতে পারেনা। যেহেতু আপেক্ষিক নৈতিকতা অনুযায়ী প্রত্যেক ব্যক্তি বা ব্যক্তি সমষ্টির নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা, বোধ-বিবেচনার ফল তাই যে কোন নির্দিষ্ট একটি কাজ বা ঘটনা একই সময়ে কিছু ব্যক্তির কাছে ভালো আবার কিছু ব্যক্তির কাছে খারাপ মনে হতে পারে। কিন্তু একটি কাজ বা ঘটনা একই সময়ে ভালো আবার খারাপ হতে পারেনা। তাই কোন কাজ বা ঘটনাকে ঠিক তখনই ভালো বা খারাপ বলা যাবে যদি এবং কেবল যদি আমাদের কাছে একটি ব্যক্তি নিরপেক্ষ মানদণ্ড থাকে, যা কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তি সমষ্টির ব্যক্তিগত মতামত, চিন্তা-চেতনা, বোধ-বিবেচনার ঊর্ধ্বে।

একটি দৃশ্যপট কল্পনা করুন, ‘ক’ নামক একটি রাষ্ট্র যেখানে আপেক্ষিক নৈতিকতা বিদ্যমান। দেশটির ৫০% মানুষ মনে করে যে, চুরি করাটা নৈতিক কাজ এবং বাকি ৫০% মানুষ মনে করে চুরি করা অনৈতিক কাজ। এমতো অবস্থায় যদি কোন ব্যক্তি নিরপেক্ষ নৈতিক মানদণ্ড না থাকে তাহলে কীভাবে বুঝতে পারবো চুরি করা নৈতিক নাকি অনৈতিক? সুতরাং, ভালো-খারাপ নির্ধারণ আমরা তখনই করতে পারি যদি এবং কেবল যদি একটি ব্যক্তি নিরপেক্ষ নৈতিক মানদণ্ড থাকে।

বঙ্গীয় নাস্তিকরা মনে করে সমকামিতা একটি নৈতিক কাজ। একজন ব্যক্তি চাইলে সে সমকামী হতেই পারে, এটা তার নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু বাংলাদেশে সমকামিতা অবৈধ এবং আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ এবং এখানকার মানুষ এটাকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখে। সেকারণে সমকামীরা এখানকার মানুষের কাছে ঘৃণিত ব্যক্তি, তাই এখানকার মানুষ কোন সমকামীর সাথে তাদের সন্তানদের মিশতে দেয় না। এখন নাস্তিক্যবাদ অনুযায়ী কোন নাস্তিক কি বলতে পারবে যে, এই দেশে মানুষকে সমকামিতার চর্চা করতে না দেওয়াটা অনৈতিক? এই দেশের মানুষ তাদের সন্তানকে সমকামীদের ঘৃণার চোখে দেখে, তাদের সন্তানদের সমকামীদের সাথে মিশতে দেয় না, এই কাজগুলো হলো অনৈতিক? যদি ব্যক্তি নিরপেক্ষ নৈতিকতা বলতে কিছু না থাকে তাহলে কোন মানদণ্ডের উপর ভিত্তি করে একজন নাস্তিক এমন কথা বলবে যে, কাউকে সমকামিতার চর্চা করতে না দেওয়াটা অন্যায় বা সমকামীদের সাথে বাচ্চাদের মিশতে না দেওয়াটা অন্যায়? এই বিষয়টি ভালোমতো বুঝার জন্য আমরা একটা কাল্পনিক গল্পের সহযোগিতা নিতে পারে। এই গল্পে আস্তিক চরিত্রে থাকবে মিসবাহ এবং নাস্তিক চরিত্রে থাকবে এলেক্স।

এলেক্সঃ বাংলাদেশের মানুষ সমকামীদের সাথে তাদের শিশুদের মিশতে দেয় না, তারা সমকামিতা চর্চায় মানুষকে বাধা দেয়। কারো ব্যক্তিগত ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার কারণে এই কাজগুলো অনৈতিক।

মেসবাহঃ আচ্ছা এলেক্স, আপনি এটা মনে করেন যে, ব্যক্তি নিরপেক্ষ নৈতিকতা বলতে কিছু নেই?

এলেক্সঃ হুম, ব্যক্তি নিরপেক্ষ নৈতিকতা বলতে কিছু নেই।

মেসবাহঃ তাহলে আপনি কোন নৈতিক মানদণ্ডের উপর ভিত্তি করে বললেন, কেউ যদি সমকামীদের ঘৃণা করে এবং তাদের সন্তানদের সমকামিতা চর্চা করতে বাধা দেওয়া অন্যায়? আপনি কি আপনার নিজের নৈতিক মানদণ্ডের উপর ভিত্তি করে এগুলোকে অনৈতিক বলেন?

এলেক্সঃ হুম… আমি আমার নৈতিক মানদণ্ডের উপর ভিত্তি করেই এই কাজগুলোকে অনৈতিক বলি এবং আমার এই অধিকার আছে।

মিসবাহঃ কিন্তু একজন ব্যক্তির নৈতিক মানদণ্ড আপনার চেয়ে ভিন্ন বলে কি তাকে নিন্দা করতে পারেন? তার কাজকে অনৈতিক বলতে পারেন? যেহেতু নৈতিকতা হলো আপেক্ষিক? আপনার কাছে যেটা নিন্দা তার কাছে সেটা নিন্দা নাও হতে পারে।

এলেক্সঃ উম……

কাল্পনিক গল্প থেকে আমরা শুধু মাত্র এটাই বুঝানোর চেষ্টা করেছি যে যদি আমরা নিজেরাই আমাদের নৈতিকতা নির্ধারণ করি তাহলে কোন ব্যক্তির কাজকে অনৈতিক বলার কোন সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে হয়ত অনেক নাস্তিক বলতে পারে, আমরা আমাদের কাজের জন্য সমাজের নিকট দায়বদ্ধ। তাই আমার কাছে কোন কাজ নৈতিক মনে হলেও সমাজ যদি সেটাকে মেনে না নেয় তাহলে সে কাজ আমরা করতে পারি না। এক্ষেত্রে আমরা যদি নাস্তিক ব্যক্তির নিকট প্রশ্ন করি, কোন সমাজের নিকট আমরা আমাদের কাজের জন্য দায়বদ্ধ? নাস্তিক ব্যক্তিটির উত্তর এটাই হবে যে, যে সমাজে আমরা বসবাস করি। ধরুন, আমরা এমন একটা সমাজে বসবাস করি যেখানে সমাজের মানুষের কাছে কাউকে হত্যা করা, ধর্ষণ করাটা অন্যায়। কিন্তু আপেক্ষিক নৈতিক মানদণ্ড অনুযায়ী যদি কোন সমাজের মানুষের কাছে কাউকে হত্যা করা, ধর্ষণ করা, অন্যায় মনে না হয় তাহলে আমরা সেটাকে অনৈতিক বলতে পারি না। যেমন, হিটলারের সমাজের লোকের কাছে ৬ মিলিয়ন ইহুদিকে হত্যা করাটা ছিল নৈতিক। তাই আপেক্ষিক নৈতিকতা বা নাস্তিক্যবাদ অনুযায়ী আপনি কখনোই হিটলারের গণহত্যাকে অনৈতিক বলতে পারেন না। তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, একই কাজ একই সময়ে এবং একই সাথে নৈতিক আবার অনৈতিক (পরস্পর বিরোধী) হচ্ছে কেবল মাত্র আপেক্ষিক নৈতিকতার কারণে। কিন্তু যুক্তি বিদ্যার মৌলিক নিয়ম অনুসারে, কোন কিছু একই সাথে পরস্পর বিরোধী অবস্থানে থাকতে পারেনা। হত্যা করা, ধর্ষণ করা, এ কাজগুলো হয় খারাপ হবে অথবা ভালো হবে। কিন্তু আপেক্ষিক নৈতিকতায় তা কিছুতেই সম্ভব নয়। যাইহোক, আমরা তখনই হিটলার বা যে কারো কাজকে অনৈতিক বলতে পারবো যখন নৈতিকতা হবে ব্যক্তি নিরপেক্ষ। যদি একটা সমাজের মানুষ মনে করে শিশুদের ধর্ষণ করা নৈতিক/অনৈতিক, আপেক্ষিক নৈতিক মানদণ্ড অনুযায়ী আমরা কোনোভাবেই এই কাজকে নিন্দা/সমর্থন করতে পারি না। তবুও আমরা যদি এর নিন্দা/সমর্থন করি, তবে তা হবে কেবল আমাদের মতামত।

কোন নাস্তিক হয়ত দাবি করতে পারে আমরা যদি গণহত্যা করি, নারীদের ধর্ষণ করি, অন্যায় কাজ করি তাহলে আমরা টিকে থাকতে পারবো না, রাষ্ট্র আমাদের উপর শাস্তি প্রয়োগ করবে। তাই আমাদের এই কাজগুলো পরিহার করতে হবে। কিন্তু এই দাবিটি সত্য নয়। পৃথিবীর ইতিহাসের দিকে তাকালে এমন অসংখ্য অপরাধী পাওয়া যাবে যারা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শাস্তিভোগ করেনি। যেমন, নাস্তিক জোসেফ স্টালিন, হিটলার, মাওসেতুং। তারা লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা করেছে কিন্তু এই দুনিয়ায় তারা বিচারের আওয়াত আসেনি। পৃথিবীর ইতিহাসে তাকালে আমরা এমন হাজারো অত্যাচারী শাসক দেখবো যারা অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা করেছে, অবর্ণনীয় অত্যাচার ও নির্যাতন করেছে। কিন্তু তারা ক্ষমতাবলে বহু মানুষের উপর অন্যায়, নির্যাতন চালিয়েও বেঁচে গেছে। অথবা, কেউ যদি হাজার হাজার লোকদের হত্যা করে নিজে সুইসাইড করে, অথবা কোনো লোক কিছু মানুষকে হত্যা করেছে কিন্তু আদালতে বিচার প্রক্রিয়া শুরুর আগেই মারা গিয়েছে। এই ধরনের লোকদের শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়নি। দেশে আইন প্রণয়ন করে কখনো মানুষকে নৈতিক বানানো সম্ভব না। আইন, দণ্ডবিধি থাকা সত্ত্বেও সমাজে হত্যা, লুট, রাহাজানি, ব্যভিচার হয়। আইনকে ফাঁকি দিয়েও মানুষ নানারকম অপরাধ করে। অর্থের বিনিময়ে আইন কিনে নিয়ে অপরাধী নির্বিঘ্নে মুক্তি পেয়ে যায়। যার ফলে, মজলুম নিপীড়িত মানুষ সুবিচার থেকে বঞ্চিত হয় এবং অপরাধী ব্যক্তিরা আইনকে ফাঁকি দিয়ে বুক ফুলিয়ে সমাজে চলাফেরা করে। সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি, নৈতিকতা কখনোই সমাজের মানুষের বোধ-বিবেচনা, চিন্তা-ভাবনা, আবেগ-অনুভূতি থেকে আসতে পারেনা। আসলেও সেটার এপ্লিকেশ্ন পসিবল না। মানব ইতিহাসে এমন কোনো নজির আছে কিনা জানা নেই, যেখানে সমাজের সকল মানুষ একত্রে বসে তাদের নৈতিকতা নির্ধারণ করেছে। তাই নৈতিকতা অবশ্যই ব্যক্তি নিরপেক্ষ হতে হবে।

আমি বিশ্বাস করি, নাস্তিকদের বিবেক যদি কখনো জাগ্রত হয়, যদি তারা ৬মিলিয়ন মানুষকে হত্যা করা বা কাউকে ধর্ষণ করাকে বৈধতা দিতে না চাই, তারা যদি এই অবস্থান থেকে ফিরে আসতে চাই যে কাউকে ধর্ষণ করা বা কাউকে হত্যা করা কেবল মাত্র কারো ব্যক্তিগত মতামতের বিষয় নয়, তবে তারা এমন একটা নৈতিক মানদণ্ডের খোঁজ করবে যে নৈতিক মানদণ্ড হবে ব্যক্তি নিরপেক্ষ, অপরিবর্তনীয়, সার্বজনীন। সেই নৈতিক মানদণ্ড আসবে এমন একজন সত্তা থেকে যিনি হবেন সর্বজ্ঞ।

ব্যক্তি নিরপেক্ষ নৈতিকতার জন্য স্রষ্টা অনিবার্য। কারণ, নৈতিকতা কোনো অণু দিয়ে তৈরি নয়। নৈতিকরা কোন ওজন নেই। সততার মধ্যে কি পরিমাণ অনু রয়েছে তা কি বলা যায়? এই প্রশ্নগুলো শ্রুতিকটু শুনাচ্ছে। কারণ মোরালিটি বা নৈতিকতা কোন অনু গিয়ে গঠিত নয়। ন্যায়বিচারের জন্য একটি অপরিবর্তনীয় ব্যক্তি নিরপেক্ষ নৈতিকতা পেতে, আপনার অণুর প্রয়োজন নেই – আপনার একটি ব্যক্তি নিরপেক্ষ, অপরিবর্তনীয় বিচারক প্রয়োজন যার সর্বোচ্চ অধিকার রয়েছে কর্তৃত্ব দেওয়ার। মানুষ তা দিতে পারে না। মানুষের চিন্তাভাবনা পরিবর্তনশীল এবং এক মানুষ অন্য মানুষের উপর নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব রাখার ক্ষমতা রাখেনা। তাই নৈতিকতার উৎস এমন কোনো সুনিপুণ সত্তা থেকে আসা লাগবে যিনি সর্বোচ্চ জ্ঞানী, এবং সর্বোচ্চ পর্যায়ে ভালো। এর জন্য স্রষ্টার প্রয়োজন। সুতরাং, স্রষ্টার অস্তিত্ব না থাকলে ব্যক্তি নিরপেক্ষ নৈতিকতারও অস্তিত্ব থাকবে না। স্রষ্টাকে বাদ দিলে নীতি-নৈতিকতাগুলো নেমে যাবে সামাজিক প্রথার স্তরে। অধ্যাপক ইয়ান মার্খাম এর মতে,

আমাদের জীবনের গভীরে লুকিয়ে থাকা রহস্যময় কর্তব্যবোধকে ব্যাখ্যা করেন ঈশ্বর। নৈতিক দাবির সর্বজনীন প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা তিনিই করতে পারেন এবং তিনিই কেবল সর্বজনীন আদেশ দিতে পারেন। কারণ, তিনিই একমাত্র জীবন-জীবিকার ঊর্ধ্বে।[3] দ্যা ডিবাইন রিয়ালিটি, হামজা জর্জিস; পৃষ্ঠা নং; ১৬০

ইসলাম ধর্মে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি সবচেয়ে ক্ষমতাধর, সবচেয়ে ভালো (আল-বার- সকল ভালোর উৎস), সবচেয়ে জ্ঞাণী (আল-হাকিম)। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তালা বলনে,

নিশ্চয় আল্লাহ অশ্লীল কাজের নির্দেশ দেন না।[4] সূরাঃ আল-আরাফ; ৭:২৮

নাস্তিকতায় নৈতিকতার অস্তিত্ব নেই

কর্মব্যস্ত কোন এক দিন শেষে বাসায় ফিরলেন। ফ্রেশ হয়ে আপনার ছোট্ট মেয়ে দিশাকে ডাকলেন। কিন্তু তার কোনো সাড়া পাচ্ছেন না। অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর পুলিশ কল করলেন। আপনি খুবই চিন্তিত যে আপনার মেয়েকে হয়ত কেউ অপহরণ করেছে। পুলিশের সাথে আপনি এবং আপনার প্রতিবেশী সহ আপনার মেয়ে দিশাকে খুঁজতে লাগলেন। কয়েকঘণ্টা পার হয়ে গেলেও তাকে খুঁজে ফেলেন না। আপনার বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে কিছু লোক বসবাস করে। তাদের বাসায় গিয়ে খোঁজ করতে দেখা মিললো আপনার কলিজার টুকরো মেয়ে দিশার রক্তাক্ত লাশ। পুলিশ অপরাধীদের জবানবন্দি নিতেই তারা স্বীকার করলো, চকোলেটের লোভ দেখিয়ে আপনার মেয়েকে তারা বাসায় নিয়ে ধর্ষণ করে। তারা খুবই ভয়ে ছিল যে, দিশা সবকিছু আপনাকে জানিয়ে দিতে পারে এবং আপনি এই ব্যাপারে আইনি পদক্ষেপ নিতে পারেন। তাই তারা ধর্ষণের পর আপনার মেয়ে দিশাকে হত্যা করেছে।

এই গল্পটা বলার কারণ হচ্ছে, এই ধরনের যে কোন ঘটনা আমাদের সবার কাছেই অপরাধমূলক। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এটি যে, বিবর্তনবাদী নাস্তিকদের কাছে এই ঘটনাটি একটি স্বাভাবিক ঘটনা। কিছু মুহূর্তের জন্য চিন্তা করুন, আপনার মেয়ে দিশাকে যারা ধর্ষণ করে হত্যা করেছে তারা কেউ এখন পর্যন্ত বিচারের আওতায় আসেনি এবং এই অবস্থায় তারা মৃত্যুবরণ করেছে। পৃথিবীতে এমন অসংখ্য ধর্ষক, হত্যাকারী রয়েছে যারা তাদের কৃতকর্মের সাজা না পেয়েই মৃত্যুবরণ করেছে। সুতরাং, যদি স্রষ্টা আসলে নাই থাকে, পরকাল বলতে আসলে কিছু না থাকে তাহলে এই দুনিয়াতে চূড়ান্ত ন্যায় বিচার বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই। ন্যায়বিচার যদি নাই থাকে তাহলে অন্যায় বলেও কোন কিছু থাকেনা। ঠিক যেমন, কোন কিছু কখনোই খারাপ হতে পারেনা যদি ভালো বলতে আসলে কিছু না থাকে। যদি স্রষ্টার অস্তিত্ব না থাকে, তাহলে কোনটা ভালো আর কোনটা খারাপ তা নির্ধারণ করবে ব্যক্তি নিজেই। কারণ স্রষ্টা না থাকলে, ব্যক্তি নিরপেক্ষ নৈতিকতা বলতে কোন কিছু থাকে না। বর্তমানে আলোচিত নাস্তিক রিচার্ড ডকিন্স এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমাদের নৈতিকতাবোধ একটি বিবর্তন প্রক্রিয়ার ফলাফল”।  সুতরাং, নাস্তিক রিচার্ড ডকিন্সের মতে, ধর্ষণ করা খারাপ কিছু না, এবং এটা নির্ভর করছে আপনার ইচ্ছার উপরে। আপনি যদি মনে করেন ধর্ষণ করা খারাপ তাহলেই ধর্ষণ খারাপ, আপনি যদি মনে করেন ধর্ষণ করা ভালো তাহলে ধর্ষণ ভালো।

নাস্তিক্যবাদ অনুযায়ী আমাদের সকল চিন্তা এবং আচরণ হচ্ছে অন্ধকার শক্তির ফলাফল। অর্থাৎ, এগুলোতে আমাদের কোনো হাত নেই। এগুলো যেভাবে হওয়ার সেভাবেই হচ্ছে। ন্যায়বিচার, নৈতিকতা এবং স্বাধীন ইচ্ছার কোনো অস্তিত্ব নেই। নাস্তিক প্রফেসর রিচার্ড ডকিন্স বলেন,

অন্ধশক্তি এবং জেনেটিক প্রতিলিপির এই মহাবিশ্বে কিছু মানুষ আঘাত পাচ্ছে আবার কিছু মানুষ ভাগ্যবান হচ্ছে। এবং এটির কোন ছন্দ বা কারণ নেই, কোন ন্যায়বিচারও নেই।……ডিএনএ জানে না বা পরোয়া করে না। ডিএনএ শুধু আছে, এবং আমরা তার সঙ্গীতে নাচি।[5] Frank Turek; Stealing from God Why Atheists Need God to Make Their Case; Chapter-4

অর্থাৎ, এই মহাবিশ্বে যা কিছু ঘটে, কেউ আঘাত পাচ্ছে, কেউ দুঃখ পাচ্ছে এগুলোর কোন কারণ নেই। এগুলো যেভাবে হওয়ার কথা সেভাবেই হচ্ছে। যা কিছু হচ্ছে সবকিছুই ডিএনএ’র কারণেই হচ্ছে। সুতরাং, কোনো মানুষ যখন ধর্ষণ করে, হত্যা করে এগুলো তার ডিএনএ’র কারণেই হচ্ছে। তাই নাস্তিক্যবাদ অনুযায়ী আপনার মেয়ে দিশাকে ধর্ষণের পর হত্যা করাটা অন্যায় নয়। এই কাজের জন্য আপনি ধর্ষণকারীদের নিন্দা করতে পারবেন না। কারণ এখানে তার কোনো হাত নেই। সে কেবল একটা জৈবিক রোবট যার প্রতিটি কাজ সম্পূর্ণরূপে প্রাকৃতিক কারণ দ্বারা নির্ধারিত। সুতরাং, বিবর্তনবাদী নাস্তিকদের মতে আমাদের প্রতিটি কাজ যেহেতু সম্পূর্ণরূপে প্রাকৃতিক কারণ দ্বারা নির্ধারিত এবং ডিএনএ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাই আমরা কোনো ব্যক্তির কাজকে নৈতিকভাবে ভুল বলতে পারি না। কারণ বিবর্তনবাদী নাস্তিকদের কোন ব্যক্তি নিরপেক্ষ নৈতিক ভিত্তি নেই। যার ফলে, তাদের কাছে একজন দানশীল ব্যক্তি যিনি তার সারাজীবনের অর্জিত অর্থ দান করে দিয়েছেন দরিদ্রদের মাঝে এই ঘটনার মতো হিটলারের গণহত্যার বিষয়ও একটা স্বাভাবিক ঘটনা।

বিজ্ঞান কি নৈতিকতা নির্ধারণ করতে পারে?   

স্রোতের বিপরীতে গা ভাসিয়ে কিছু নাস্তিক আবার ব্যক্তি নিরপেক্ষ নৈতিকতাকে স্বীকার করে নেয়। যেমন, বর্তমানে সবচাইতে জনপ্রিয় নাস্তিকদের একজন হলো স্যাম হ্যারিস। তিনি তার লিখিত ‘দ্যা মোরাল ল্যান্ডস্কেপ’ বইতে উল্লেখ করেন,

ব্যক্তি নিরপেক্ষ নৈতিকতা সচেতন প্রাণীদের মঙ্গলের সাথে সম্পর্কিত এবং বিজ্ঞান আমাদের সহযোগিতা করতে পারে কি সচেতন প্রাণীদের জন্য মঙ্গল নিয়ে আসে।[6] Frank Turek; Stealing from God Why Atheists Need God to Make Their Case; Chapter-4

স্যাম হ্যারিসের এই অবস্থানের সমস্যা হচ্ছে, আমরা কোন পদ্ধতি দিয়ে নৈতিকতা আবিষ্কার করবো তার জন্য তিনি বিজ্ঞানের আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু যে পদ্ধতি দিয়েই নৈতিকতা আবিষ্কার করি না কেন, এতে এটা প্রমাণ হয় না যে নৈতিকতা সেই পদ্ধতি সৃষ্টি করেছে। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে কেন নৈতিকতা বিদ্যমান? বিজ্ঞান নিশ্চয় নৈতিকতা বিদ্যমান হওয়ার কারণ নয়। বিজ্ঞান কোন কিছু সৃষ্টি করতে পারেনা। বিজ্ঞান হচ্ছে একটা মাধ্যম যারা সাহায্যে আমরা আমাদের এই মহাবিশ্বের ঘটনাগুলোকে ব্যাখ্যা করতে পারি পর্যবেক্ষণ ও পরিক্ষণের মাধ্যমে। সুতরাং, তর্কের খাতিরে যদি আমরা এটা মেনেও নি যে বিজ্ঞান আমাদের নৈতিকতাকে আবিষ্কার করতে সহযোগিতা করতে পারে কিন্তু বিজ্ঞান কখনোই নৈতিকতা সৃষ্টি করতে পারেনা।

ধরুন, একটা ছেলেকে ছুড়ির আঘাতে হত্যা করা হয়েছে। এখানে বিজ্ঞান আমাদের জানাতে পারে, ছুরি ছেলেটার শরীরে কত সেন্টিমিটার প্রবেশ করেছে, তার শরীর থেকে কতখানি রক্ত প্রবাহিত হয়েছে। ছুড়ির আঘাতে তার শরীরের কতখানি অংশ কাটা পড়েছে, ইত্যাদি। কিন্তু বিজ্ঞান কখনোই এটা বলতে পারে না যে ছেলেটাকে ছুরি দিয়ে হত্যা করাটা নৈতিকভাবে সঠিক নাকি ভুল হয়েছে। তাই প্রশ্ন থেকেই যায়, যদি স্রষ্টা না থাকে কেন নৈতিকতা বিদ্যমান?  স্রষ্টার অস্তিত্ব অস্বীকার করে আপনি কখনোই এই প্রশ্নের সুরহা করতে পারবেন না। এই বইটি আমি লিখেছি তা অস্বীকার করেও বইতে আমি কি লিখেছি তা আপনি জানতে পারেন। কিন্তু আপনি যদি বলেন আমার অস্তিত্বই নেই তাহলে এই বইটি সম্পর্কেও আপনি কখনোই জানতে পারতেন না। ঠিক তেমনি, নৈতিকতা স্রষ্টা দিয়েছে এটা অস্বীকার করেও নাস্তিকরা নৈতিকতা সম্পর্কে জানতে পারে। কিন্তু স্রষ্টাকে অস্বীকার করে তারা নৈতিকতা নির্ধারণ করতে পারেনা। যদি করে তবে তারা স্রষ্টা থেকে সেই নৈতিকতা চুরি করে।

বিবর্তনবাদ দিয়ে কি নৈতিকতাকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব?

ধরুন, আমাদের এই দুনিয়ার জীবন একমাত্র জীবন। পরকাল, স্রষ্টা এগুলো সব মানুষের বানানো, এসবের বাস্তব কোনো অস্তিত্ব নেই। সবকিছু বিবর্তনের ফসল। তাহলে এই দুনিয়াতে আমাদের এতো আয়োজন, এতো কার্যাবলি এগুলো আমরা কেন করছি? এর উত্তর হচ্ছে, টিকে থাকার জন্য, নিজেকে ভালো রাখার জন্য। বিবর্তনের ভাষায় যাকে বলে Survival of the fittest. এতসব আয়োজন যদি নিছকই টিকে থাকার জন্য হয়ে থাকে তাহলে টিকে থাকার তাগিদে যা কিছুর করার প্রয়োজন তা কিছু করা উচিত আমাদের। এমতাবস্থায় আমাদের কাছে ভালো মন্দের ভিত্তি হবে, আমার টিকে থাকার জন্য যা করা দরকার তা ভালো, আর যা আমাকে টিকে থাকতে দিচ্ছে না সেটা খারাপ। সুতরাং, এই দর্শনে চুরি করা, ছিনতাই করা, ধর্ষণ করা এগুলোকে আমরা খারাপ বলতে পারি না। যার পেটে ভাত নেই তার টিকে থাকার জন্য চুরি করা প্রয়োজন। যার অর্থ নেই, অর্থের অভাব মোছন করার জন্য তার ছিনতাই করা প্রয়োজন। জৈবিক চাহিদা পূরণ করার জন্য কেউ ধর্ষণও করতে পারে। এগুলো কেবল টিকে থাকার তাগিদেই হয়। আর এ কারণেই হয়ত দার্শনিক ফ্রেড্রিক নিৎসে বলেছেন,

প্রকৃতি ও প্রাণিজগতে নিরন্তর আত্মরক্ষা ও বাঁচার সংগ্রাম চলছে। এই বাঁচার সংগ্রামের পরিমাণ হচ্ছে- ক্ষমতা বিস্তারের অদম্য ইচ্ছা। তাই শোষক, শোষিত বা দাস, প্রভু এগুলো প্রকৃতিগত ব্যাপার। শোষণ করা প্রত্যেক মানুষেরই চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য আর দাস হওয়াটাও বাঁচার সংগ্রামে পরাজিত পক্ষের অনিবার্য ভাগ্য। পরাজিত পক্ষের দাসত্ব বরণ করা হলো- বাস্তব সত্যের স্বীকৃতি।[7] মুক্তচিন্তা ও ইসলাম; মুজাজ্জাজ নাঈম, পৃষ্ঠা নং-৯৬

আরেকটু চিন্তা করে দেখুন, এই দুনিয়ার জীবনই যদি একমাত্র জীবন হয়, মৃত্যুর মাধ্যমে এই জীবনের সমাপ্তি ঘটবে, কোনো জবাবদিহিতা নেই মৃত্যুর পর- যদি আসলেই এমন হয়, তো আমি কেন অন্যের সম্পত্তি লুট করে বড়লোক হবো না? মানুষতো সুখবাদী! আমি কেন সুখ থেকে বঞ্চিত হবো? এই জীবনকে যদি একটা সরল অঙ্কের সাথে তুলনা করি- তাহলে এই অঙ্কের ফলাফল যদি কেবল শূন্যই হয় তাহলে কেন আমি এই জীবনে নিজের অর্থ সম্পদ বিলিয়ে অন্যকে খুশি করবো? কেন আমি এই জীবনকে উপভোগ করবো না? কেন আমি ক্ষমতাবান হয়ে সবার সম্পত্তি লুটতরাজ করবো না? বিবর্তনবাদী দর্শনে এই প্রশ্নগুলোর কোন উত্তর নেই। বরং এই দর্শন আমাদের শিখিয়ে যায়, শক্তিমানেরা টিকে থাকবে, দুর্বলরা পরাজিত হবে। তাই এখানে নৈতিক অনৈতিক বলে কিছু নেই। নাস্তিক রিচার্ড ডকিন্স ও স্যাম হ্যারিস হয়ত এই কারণে নৈতিকতার ক্ষেত্রে ডারউইনিজমের বিপক্ষে অবস্থান করে। ডকিন্স ABC Radio National এর একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন,

অতীতে বিবর্তনের উপর নৈতিকতার ভিত্তি করার চেষ্টা করেছে। আমি এমনটা করতে চাইনা। একজন বিবর্তনবাদীর নিকট যে ধরনের বিশ্ব তা ‘survival of the fittest’ (যোগ্যতমের বেঁচে থাকা) এর দিকে ফিরে যাচ্ছে এবং প্রকৃতি এখন দাঁত ও নখের আঘাতে রক্তে রঞ্জিত। ……..ডারউইনবাদের উপর ভিত্তি করে যে রাজনীতি তা আমার জন্য খারাপ রাজনীতি হবে, তা হবে অনৈতিক। এটিকে অন্যভাবে বললে, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আমি একজন অনুরাগী ডারউইনিয়ান, যখন এটি বিশ্বকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে আসে, তবে নৈতিকতা এবং রাজনীতির ক্ষেত্রে আমি একজন উৎসাহী ডারউইন বিরোধী।[8] The Descent of Man – The Moral Animal (full transcript) (abc.net.au)

এছাড়াও, নৈতিকতা এবং বায়োলজি পুরোপুরি আলাদা ক্যাটাগরি। তাই কেউ যদি এই দুটোকে গুলিয়ে ফেলে, অর্থাৎ নৈতিকতাকে বায়োলজি বা বিবর্তন প্রক্রিয়ার সাহায্যে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে তাহলে অবশ্যই ক্যাটাগরি মিস্টেক ফ্যালাসি ঘটবে। ক্যাটাগরি মিস্টেক ফ্যালাসি বলতে বুঝানো হয়, কোন একটা বিভাগের অন্তর্গত কিছুকে যদি অন্য বিভাগের মনে করা বা অন্য বিভাগের সাহায্যে ব্যাখ্যা করতে চাওয়া। যারা নৈতিকতাকে জীববিজ্ঞানের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করতে চাই তাদের কাছে আমাদের প্রশ্ন থাকবে, নৈতিকতার রাসায়নিক গঠন কেমন? নৈতিকতার স্বাদ কেমন? নৈতিকতার গন্ধ কেমন? এগুলোর কোনোটিই নৈতিকতার মধ্যে নেই। সুতরাং, নৈতিকতাকে যদি বিবর্তনবাদ বা জীববিজ্ঞানের সাহায্যে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হলে সেখানে অবশ্যই ক্যাটাগরি মিস্টেক ফ্যালাসি ঘটবে। নৈতিকতা এবং জীববিজ্ঞান আলাদা বিভাগের। আপনি কখনোই অবস্তুগত নৈতিকতাকে বস্তুগত জৈবিক প্রক্রিয়া দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারবেন না। জেনেটিক কোডের কি এই কর্তৃত্ব থাকতে পারে যে আপনাকে বলে দিবে আপনার কি করা উচিত? অবশ্যই পারেনা। তবুও যদি আমরা কিছু সময়ের জন্য তর্কের খাতিরে মেনেও নেয় যে, জীববিজ্ঞান দিয়ে নৈতিকতাকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব তাহলে ব্যক্তি নিরপেক্ষ ভালো-খারাপ বলতে আর কোন কিছুর অস্তিত্ব থাকে না। যদি আমাদের নৈতিক আচরণ বিবর্তন প্রক্রিয়া বা জীববিজ্ঞানের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয় তাহলে আমাদের আচরণের উপর আমাদের কোন নিয়ন্ত্রণ থাকেনা। সব কিছুই প্রাকৃতিক কারণে হয়। একটা ধর্ষক যখন ধর্ষণ করে তা যেমন প্রাকৃতিক কারণে হয় তেমনি একজন দানশীল যখন দান করে সেটাও প্রাকৃতিক কারণে হয়। যেহেতু আচরণের উপর ব্যক্তির কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না তাই কোন কাজের জন্য আমরা ব্যক্তিকে ক্রেডিট বা ডিসক্রেডিট দিতে পারি না। তাই নৈতিকতা যদি বিবর্তন প্রক্রিয়া বা জীববিজ্ঞানের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয় তাহলে ভালো-খারাপ বলতে কোন কিছুই এক্সিস্ট করে না। সবকিছুই প্রাকৃতিক নির্বাচন।

ইউথিফ্রোর উভয় সংকট

নাস্তিক্যবাদের অনুসারিগণ ব্যক্তি নিরপেক্ষ নৈতিকতা স্রষ্টা থেকে আসতে হবে এমন দাবিকে খণ্ডন করতে একটি আপত্তি তুলে থাকেন। তাঁদের মতে, স্রষ্টার মধ্যেও ব্যক্তি নিরপেক্ষ নৈতিকতা স্থাপন করা যায় না। কারণ হিসেবে তারা ইউথিফ্রোর উভয় সংকট দেখানোর চেষ্টা করে। ইউথিফ্রোর সংকটটি এমন যে, স্রষ্টা আদেশ করেছেন বলেই কি কোন কিছু ভালো নাকি কোন কিছু নৈতিক বলেই স্রষ্টা আদেশ করেছে?

নৈতিকতা যদি আল্লাহর আদেশের উপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হয় তাহলে, কোনটা ভালো আর কোনটা খারাপ তা একনায়ক সুলভ বা স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্ত হবে। অন্যদিকে কোন কাজ নৈতিক বলেই যদি স্রষ্টা সেগুলোকে নৈতিক বলেন তাহলে স্রষ্টা নিজেই নৈতিক নিয়মের মধ্যে আবদ্ধ। যদি তাই হয় তাহলে স্রষ্টাকে আর কোনোভাবেই সবচেয়ে শক্তিমান বলা যাবেনা।

তবে এই আপত্তিকে মোটেও ইউথিফ্রোর সংকট বলা যায় না। ইউথিফ্রোর সংকটে শুধু মাত্র দুটি বিপরীত বিকল্প রয়েছে। যেমন, A বা -A। কিন্তু নাস্তিকরা এখানে আগে থেকেই কোন প্রকার যুক্তি ছাড়াই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে যে, স্রষ্টা আদেশ করেছেন বলেই কোন কিছু নৈতিক হবে অথবা নৈতিক বলেই স্রষ্টা আদেশ করেছেন। কিন্তু এখানে তৃতীয় আরো একটা বিকল্প থাকতে পারে। স্রষ্টা যেহেতু সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ, স্ব-নির্ভর সেহেতু নৈতিক মানদণ্ডের জন্য স্রষ্টাকে অন্য কিছুর উপর নির্ভরশীল হতে হয় না। যদি অন্য কোন মানদণ্ডের উপর নির্ভর করতে হয় তাহলে তিনি স্রষ্টা হবেন না। এছাড়া, স্রষ্টা স্বেচ্ছাচারী নন।

যাইহোক, আমাদের তৃতীয় বিকল্প হল স্রষ্টা স্বভাবগতভাবে নৈতিক। ন্যায়পরায়ণতার মান যাকে আমরা নৈতিক আইন বলে জানি তা স্বয়ং স্রষ্টার প্রকৃতি থেকে প্রবাহিত হয়। ইসলামী বিশ্বাস অনুযায়ী, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা অনিবার্যভাবে এবং নিখুঁতভাবে কল্যাণময়। আল্লাহর প্রকৃতিই হচ্ছে নিখুঁত যৌক্তিক নৈতিক মানদণ্ড। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন,

নিশ্চয় আল্লাহ অশ্লীল কাজের নির্দেশ দেন না।[9] সূরাঃ আল-আরাফ; ৭:২৮

সুতরাং, কোনো কাজ এই কারণে খারাপ নয় যে, তা সকল মানুষের কাছে খারাপ মনে হচ্ছে। অথবা, কোনো কাজ সকল মানুষের কাছে ভালো মনে হচ্ছে বলেই সেটা ভালো নয়। বরং স্রষ্টা নির্ধারিত ব্যক্তি নিরপেক্ষ নৈতিক মানদণ্ডের কারণেই কোনো কাজকে আমরা ভালো বা খারাপ বলতে পারি। স্রষ্টা এই নৈতিক মানদণ্ডের অধীন নয়। কারণ, নৈতিক হওয়াটা স্রষ্টার সত্তার মধ্যেই রয়েছে।

আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও নৈতিক চরিত্র গঠন 

স্রষ্টার অস্তিত্ব ব্যতীত ব্যক্তি নিরপেক্ষ নৈতিকতা থাকা পসিবল নয়। অন্যদিকে, ব্যক্তি নিজেই নিজের নৈতিকতা নির্ধারণ করবে এটিও স্ববিরোধী মতবাদ। তাই ব্যক্তি নিরপেক্ষ নৈতিকতা এবং স্রষ্টার অস্তিত্ব থাকা আবশ্যক। স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাস ছাড়া যে মানুষ নৈতিক হতে পারবেনা বিষয়টা এমন নয়। উপরে আমরা দেখেছি যদি স্রষ্টা না থাকে, মানুষ যদি কেবল বিবর্তনের ফসল হয় তাহলে বোকা মানুষ ছাড়া কেউ নৈতিক হবেনা। যদি পরকাল না থাকে, যদি এই দুনিয়ার জীবনই একমাত্র জীবন হয়, কোনো প্রকার জবাবদিহিতা না থাকে তাহলে কেন আমি অন্যের উপকার করবো? কেন আমি অন্যের ক্ষতি করে নিজে সুখে থাকবো না?

একজন নৈতিক মানুষ হতে গেলে আমাদের প্রথমে অপরাধ দমন করার চাইতে অপরাধের মূলোৎপাটন কাম্য হওয়া উচিত। মানুষের ভেতরে সর্বপ্রথম অপরাধের প্রবণতা জন্মলাভ করে তার মনের গহিন কোনে। আশপাশের কুরুচিপূর্ণ পরিবেশ, পাপাচারীদের সাহচর্য, অশ্লীল নাটক-সিনেমা, লোভ-লালসা, হিংসা ইত্যাদি মানুষের নৈতিকতা ধ্বংসের সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তাই আমাদের উচিত মনের মধ্যেই এই প্রবণতাগুলোর অংকুরে বিনষ্ট করে দেওয়া। তার জন্য প্রয়োজন খোদাভীতি, পরকালের বিশ্বাস। মানুষের অন্তরে যদি দৃঢ় বিশ্বাস থাকে যে দুনিয়ার জীবনই একমাত্র জীবন নয়, মৃত্যুর পরেও আরেকটা জীবন অপেক্ষা করছে আমার জন্য, দুনিয়ার কর্মকাণ্ডের হিসেব সেখানে দেওয়া লাগবে এবং চাইলেও সেই বিচার ব্যবস্থাকে ফাঁকি দেওয়া সম্ভবনা- এমন বিশ্বাস মানুষকে সকল প্রকার অনৈতিক কাজ থেকে দূরে রাখতে পারে। এই ব্যাপারে একটা দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করছি,

খলিফা হযরত উমর (রাঃ) এর শাসনামলে মদীনার উপকন্ঠে এক মহিলা ও তার মেয়ে বসবাস করতো। একদিন রাতে মহিলা দুধে কিছু পানি মিশিয়ে দেয়, বেশি দাম পাওয়ার জন্য। এটা দেখে মেয়েটা তার মাকে বললো- খলিফা দূর্নীতিকারীদের জন্য শাস্তি ঘোষণা করেছেন!

জবাবে মহিলাটি বললো, রাত্রী বেলায় কেউ দেখবেনা।

মেয়েটা বললো- তারা আমাদের দুষ্কর্ম না দেখতে পারে, কিন্তু আল্লাহর চক্ষুকে কি তুমি ফাঁকি দিতে পারবে? কিয়ামতের মাঠে আমরা ধরা পড়ে যাবো। এ কথা শুনে মহিলা তার নিজের ভুল বুঝতে পারে।[10] মৃত্যু যবনিকার ওপারে; আব্বাস আলী খান, পৃষ্ঠা নং; ২৯-৩০

এই দৃষ্টান্তের মধ্যেও দেখুন, যতক্ষণ স্রষ্টার ভয় ছিল না ততক্ষণ মহিলাটি অপরাধ করার জন্য একটুও অনুতপ্ত ছিল না, বরং রাষ্ট্রীয় আইন ফাঁকি দিয়ে অপরাধ করার চেষ্টা করেছিলো। একমাত্র আল্লাহর ভয়ই তাকে অপরাধের পথ থেকে ফিরিয়ে এনেছে।

নাস্তিক্যবাদ সম্পর্কীত অন্যান্য লিখা পড়ুনঃ নাস্তিক্যবাদ – Faith and Theology (faith-and-theology.com)

References

References
1 Definitions from Oxford Languages
2, 5, 6 Frank Turek; Stealing from God Why Atheists Need God to Make Their Case; Chapter-4
3 দ্যা ডিবাইন রিয়ালিটি, হামজা জর্জিস; পৃষ্ঠা নং; ১৬০
4, 9 সূরাঃ আল-আরাফ; ৭:২৮
7 মুক্তচিন্তা ও ইসলাম; মুজাজ্জাজ নাঈম, পৃষ্ঠা নং-৯৬
8 The Descent of Man – The Moral Animal (full transcript) (abc.net.au)
10 মৃত্যু যবনিকার ওপারে; আব্বাস আলী খান, পৃষ্ঠা নং; ২৯-৩০

Sazzatul Mowla Shanto

As-salamu alaykum. I'm Sazzatul mowla Shanto. Try to learn and write about theology and philosophy.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button