সৃষ্টিকর্তা কি সত্যিই আছেন

সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব

সৃষ্টিকর্তা কি সত্যিই আছেন

মানব মনের স্বাভাবিক একটি প্রশ্ন হলো এই মহাবিশ্বের উৎপত্তি কোথা থেকে হয়েছে। মহাবিশ্বের উৎপত্তির পিছনে কি  কোনো বুদ্ধিমান সত্তার হাত রয়েছে? সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব কি সত্যিই আছে? দুনিয়ার এই জীবনই কি একমাত্র জীবন, নাকি এরপরেও কোন জীবন আছে? মৃত্যুর সাথে সাথেই কি এই জীবনের সমাপ্তি, নাকি এর পরেও পরকালের জীবনের জের টানতে হবে? মানব মনের স্বাভাবিক এসব প্রশ্নের জের ধরে যুগে যুগে মানুষের মধ্যে নানারকম মতবাদের সৃষ্টি হয়েছে যা এখনো চলমান। এসব প্রশ্নের ভিত্তিতে প্রধানত দুটি বিপরীতমুখী মতবাদ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে পরিচিত। একটি সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের পক্ষে এবং অন্যটি সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের বিপক্ষে। এখানে আমরা সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের পক্ষের মতবাদ নিয়ে আলোচনা করবো। 

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের পক্ষে আস্তিকরা যে যুক্তিগুলো দিয়ে থাকে  তার সত্যতা কি? সৃষ্টিকর্তা কি সত্যিই আছেন?  সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের  পক্ষের মতবাদগুলো কি সঠিক নাকি নেহায়েৎ আন্দাজ অনুমান ও কুসংস্কারের মায়াজাল? 

এখানে আমরা দুটি বিষয় নিয়ে বিস্তারিত লিখার চেষ্টা করবো। ১. সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের প্রমাণ চাওয়া কি যৌক্তিক? ২. সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের পক্ষে মতবাদগুলো কতটা যৌক্তিক? 

সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের প্রমাণ চাওয়া কি যৌক্তিক?

একজন সচেতন মানুষ হিসেবে সব কিছুর পিছনে যুক্তি, প্রমাণ খুঁজি আমরা।তবে এমন কতগুলো বিষয় রয়েছে যেগুলোর জন্য কোনো প্রমাণ বা যুক্তির প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ, যা কিছু নিজেই নিজের অস্তিত্বের প্রমাণ। যা স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে পরিচিত।

স্বতঃসিদ্ধ এমন এক ধরনের উক্তি বা সাক্ষ্য যাকে কোনো প্রকার প্রমাণ ছাড়াই সত্য বলে ধরে নেওয়া হয় বা স্বীকার করে নেওয়া হয়। এ ধরনের উক্তি বা সাক্ষ্য নিজেই নিজের প্রমাণ এবং কোন প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্তে উপনীত হতে অবশ্যই এদের সত্য বলে ধরে নিতে হয়। উদাহারণ, ২+২=৪। গাণিতিক এই সিদ্ধন্তটি নিজে নিজেই সত্য। এটাকে সত্য প্রমাণ করার প্রয়োজন নেই বা প্রমাণ করাও সম্ভব না। 

 স্বতঃসিদ্ধ বিশ্বাসের একটা অংশ হলো সহজাত বিশ্বাস। সহজাত বিশ্বাস  বলতে বুঝায়, মানুষের ভেতরে জন্মগত ধারণা। অর্থাৎ এ ধরণের বিশ্বাসগুলো কেউ আমাদের শিখিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন হয়না। বরং, যা হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত চিন্তাভাবনা এবং বোধবিবেচনা থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বুঝে নেওয়া। এক কথায়, জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে শেখা নয় যে জ্ঞান তাই সহজাত জ্ঞান বা সহজাত ধারণা। যা কিছু আমরা স্বাভাবিকভাবেই স্বতঃসিদ্ধ সত্য বলে মনে করি। উদাহারণ হিসেবে আমরা বলতে পারি আমাদের এই বহির্জগতের অস্তিত্ব।

যে জীবনকে আমরা বাস্তব মনে করে দিনানিপাত করি, ধুলো ধূসর ইট পাথরের এই যান্ত্রিক শহরে বা সাদামাটা সহজ-সরল নিখাদ গ্রমীণ জীবনে রচনা করি কতশত গল্প-কাব্য; সে জীবন কি স্রেফ কোন স্বপ্ন? নাকি আসলেই এর বাস্তব কোনো অস্তিত্ব আছে? প্রশ্নটি হয়তো খুব শ্রুতিকটু শোনাবে। কিন্তু আপনি কি নিশ্চিত আপনার এই জীবন স্বপ্নের মতো কোনো ব্যাপার নয়?

অথাবা যদি প্রশ্ন করা হয়, আপনার অস্তিত্বের প্রমাণ কি? দর্শন সম্পর্কে যাদের টুকটাক পড়াশোনাও রয়েছে তারা হয়তো চট করে বলে উঠবে, এর উত্তর দার্শনিক রেনে ডেকার্ট অনেক আগেই দিয়েছে। ডেকার্টের সেই বিখ্যাত উক্তি, “I think, therefore I am” অর্থাৎ, “আমি চিন্তা করি, সুতরাং আমি আছি।”

দার্শনিক ডেকার্টের দার্শনিক পদ্ধতি ছিলো সংশয় পদ্ধতি। তিনি সার্বজনীন সত্য জ্ঞান আবিষ্কার করার জন্য সবকিছুকে সংশয় করা শুরু করেন। কিন্তু একটা সময় ডেকার্ট লক্ষ্য করেন যে, আমি যে সংশয় করি, এই সংশয় করার জন্যই তো আমাকে অস্তিত্বশীল হতে হচ্ছে। যদি আমার অস্তিত্ব না থাকে তাহলে চিন্তা করে কে? এভাবে ডেকার্ট তার নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করেন।

কিন্ত ডেকার্টের এই কথার নিশ্চয়তা কি? কেউ যদি আপত্তি করে বলে থাকে, এমনও তো হতে পারে; আপনি কেবল দূরের কোনো অজানা গ্রহের একটি পাত্রের মধ্যে ভেসে বেড়ানো নিছক এক মস্তিষ্ক। আর তাতে কলনাঠি নাড়িয়ে আপনার হৃদিয়ে অনুভূতির সৃষ্টি করছে কোনো এলিয়েন। আপনি কি নিশ্চিত, আপনি দূর অজানা কোনো গ্রহের জারে ভেসে থাকা কোনো মস্তিস্ক নন?       

নিশ্চিতভাবে এই প্রশ্নের জবাব দেওয়া কখনোই সম্ভব নয়। বরং আমাদের এই মহাজগত যে বাস্ততবে অস্তিত্বশীল এহেন বিশ্বাসকে আমরা স্বতঃসিদ্ধ মনে করি। এ ধরনের বিশ্বাসের জন্য আমরা কোনো যুক্তি খুঁজতে যায়না। কোনো প্রকার প্রমাণ ছাড়াই আমরা এগুলো বিশ্বাস করি। দর্শনের ভাষায় এ ধরণের বিশ্বাসগুলোকে দর্শনের ভাষায় Self-evident truth.

নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের আলোচিত দার্শনিক(নাস্তিক) প্রফেসর ডেভিড শালমার্স বলেন,

আমাদের এই বিশ্বজগৎ যে প্রকৃতই অস্তিত্বশীল তার পক্ষে আপনি কোনো প্রমাণ খুঁজে পাবেন না। কারণ আমরা যে প্রমাণই পাই না কেন, সেটাও অবস্তাব হতে পারে”। [1]Are We Living in a Computer Simulation? – Scientific American 

স্রষ্টার অস্তিত্ব, বহির্জগতের অস্তিত্ব, আমাদের চিন্তাজগতের অস্তিত্ব, আমাদের যুক্তির বৈধতা, এই বিষয়গুলোও স্বতঃসিদ্ধ।

সৃষ্টিকর্তা স্বতঃসিদ্ধ হওয়ার স্বপক্ষে প্রমাণ 

মনে করুন একদল শিশুকে জনমানবহীন কোনো মরুদ্বীপে ফেলে রাখা হলো। এবং তারা নিজেরাই সেখানে বেড়ে উঠতে লাগলো। সেখানে তারা কি এই বিশ্বাস নিয়ে বেড়ে উঠেবে, “জগতের অস্তিত্বে আসার পেছনে একজন অতিপ্রাকৃতিক কোনো সত্তার হাত রয়েছে?” নাকি তারা এই বিশ্বাস নিয়ে বেড়ে উঠবে, “এই জগত অস্তিত্বে আসার জন্য কোনো অতিপ্রাকৃতিক সত্তা বা সৃষ্টিকর্তার প্রয়োজন নেই বা সৃষ্টিকর্তার ধারণাই তার ভেতরে জন্ম নিবেনা।” 

একজন নাস্তিক হয়তো খুব সহজেই উত্তর দিবে অবশ্যই মরুদ্বীপে বেড়ে উঠা শিশুগুলো এই বিশ্বাস নিয়ে জন্ম নিবে যে, “এই জগত অস্তিত্বে আসার জন্য কোনো অতিপ্রাকৃতিক সত্তা বা সৃষ্টিকর্তা নেই বা সৃষ্টিকর্তার ধারণাই তার ভেতরে জন্ম নিবেনা।” কিন্তু কগনেটিভ সাইন্টিস্ট ও গবেষকগণ ভিন্ন সুরে কথা বলে। গবেষকদের দাবী অনুযায়ী শিশুরা সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের বিশ্বাসের পূর্ব ধারণা নিয়েই জন্মগ্রহণ করে। শিশুরা সহজাতভাবেই প্রকৃতিতে বুদ্ধিমান সত্তার ছাপ দেখতে পায়।

তাই ধর্মীয় বিশ্বাস, সৃষ্টিকর্তার বিশ্বাস এগুলো পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় নাস্তিকদের এহেন দাবী সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।

University of Oxford এর Center for Anthropology and mind বিভাগের সিনিয়র রিসার্চার Dr. Justin Barrett দীর্ঘ ১০ বছরের শিশুদের উপর বৈজ্ঞানিক গবেষণা করেছেন। তার গবেষণার উপর “Born Believers: The Science of Children’s Religious Belief” শিরোনামে একটি বই প্রকাশ করেছেন। বইটিতে তিনি ডেভেলোপমেন্টাল সাইকোলজি। কগনিটিভ এনথ্রোপলোজি এবং কগনিটিভ সাইন্স অব রিলিজিয়ন সহ বিভিন্ন গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফলাফল একত্রে করে আলোচনা করেছেন। তিনি মনে করেন, “শিশুরা জন্ম থেকেই স্বভাবজাত ধর্মে বিশ্বাসী। 

বইতে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন যে, কিভাবে মানুষের মধ্যে স্বভাবতই ঐশ্বরিক শক্তির বিশ্বাস গড়ে উঠে। শিশুরা শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক শক্তির অস্তিত্ব অনুভব করে যিনি বুদ্ধিমান এজেন্ট এবং এমন শক্তিশালী নিয়ন্ত্রক যা সূর্যকে আলোকিত করে এবং রাতের পতন ঘটায়। [2]Dr. Justine L. Barrett, Born Believers: The Science of Children’s Religious Belief; Chapter 6: Natural Religion.   

এছাড়াও বিবিসি রেডিওতে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তার গবেষণা সম্পর্কে Dr. Justin Barrett বলেন,

আপনি যদি কিছু সংখ্যক শিশুকে কোনো দ্বীপে রেখে আসেন আর তারা নিজেরাই বেড়ে উঠে আমি মনে করি তারা স্রষ্ট্রায় বিশ্বাস করবে। [3]BBC – Today 

 

একইভাবে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানি Dr. Olivera Petrovich পিয়ার রিভিউ জার্নালে তার গবেষণার ফলাফল জানান, 

কিছু ধর্মীয় বিশ্বাস যে সার্বজনীন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে (যেমন, কোনো অতিপ্রাকৃতিক সত্তাকে বিশ্বজগতের স্রষ্ট্রা হিসেবে মৌলিক বিশ্বাস), এর পক্ষে শক্তিশালী প্রমাণ ধর্মগ্রন্থের বাণীর চেয়ে বরং বৈজ্ঞানিক গবেষণা থেকেই বেশি বেরিয়ে আসছে বলে প্রতিয়মান হচ্ছে। [4]DOISerbia – Key psychological issues in the study of religion – Petrović, Olivera (nb.rs) এই বিষয়ে, নাস্তিকতা কি স্বভাবজাত? আর্টিকেলে আরো বিস্তারিত লিখা ও রেফারেন্স রয়েছে। 

এসব গবেষণা থেকে প্রতীয়মান হয় যে সৃষ্টিকর্তার বিশ্বাস হচ্ছে সহজাত। আর সহজাত হলো স্বতঃসিদ্ধ বিশ্বাস এর অংশ।যেহেতু স্বতঃবিশ্বাস গুলো নিজেই নিজের অস্তিত্বের প্রমাণ সেহেতু সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের প্রমাণ সৃষ্টিকর্তা নিজেই। তাই সৃষ্টিকর্তার প্রমাণ চাওয়াটা একেবারেই অযৌক্তিক। ২+২= ৪ এটার স্বপক্ষে প্রমাণ চাওয়া যেমন অযৌক্তিক তেমনি সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের প্রমাণ চাওয়াটাও অযৌক্তিক।     

সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের পক্ষে মতবাদগুলো কতটা যৌক্তিক?

সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের পক্ষে বেশকিছু যুক্তি রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, ১. কালাম কসমোলিজ্যাক আর্গুমেন্ট ২. আর্গুমেন্ট ফ্রম ডিফেন্ডেন্সি ৩. অন্টোলজিক্যাল আর্গুমেন্ট। 

এই আর্গুমেন্ট গুলো নিয়ে আমাদের ওয়েবসাইটে আলাদা আলাদা লিখা রয়েছে তাই এখানে আবার বিস্তারিত লিখার প্রয়োজন মনে করিনা। আর্গুমেন্টগুলোর লিংক দেওয়া আছে আপনারা চাইলে আলাদা আলাদা পড়ে নিতে পারবেন।  

References

References
1 Are We Living in a Computer Simulation? – Scientific American
2 Dr. Justine L. Barrett, Born Believers: The Science of Children’s Religious Belief; Chapter 6: Natural Religion.
3 BBC – Today
4 DOISerbia – Key psychological issues in the study of religion – Petrović, Olivera (nb.rs)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button