ইসলামের সত্যতার প্রমাণ কি? এই চার শব্দের প্রশ্নের উত্তর মোটামুটি বেশ দীর্ঘ হওয়াটাই স্বাভাবিক তবে যথাসম্ভব সহজ এবং সংক্ষিপ্ত করার চেষ্টা করব ইন শা আল্লাহ৷
Human Nature: মানব প্রকৃতি
প্রথমত স্রষ্টার অস্তিত্বের প্রমাণ চাওয়া ঠিক ততটাই উদ্ভট যতটা না নিজেকে এই প্রশ্ন করাটা যে আমার অস্তিত্ব কি আসলেই আছে? অর্থাৎ আপনার অস্তিত্ব কিন্তু কোনো জাস্টিফিকেশান ছাড়াই সত্য। যেমন আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেন,
“তুমি একনিষ্ঠভাবে নিজেকে ধর্মে প্রতিষ্ঠিত রাখো। আল্লাহর সেই ফিতরাতের (প্রকৃতি) অনুসরণ কর; যে প্রকৃতি অনুযায়ী তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন।”[আল কুরআন, রুম ৩০ : ৩০]
প্রপার্লি বেসিক বিলিভ হচ্ছে জ্ঞানতত্ত্বের অন্যতম একটি অংশ। যাকে নিয়ে ডিল করে ফাউন্ডেশনালিজম। ফাউন্ডেশনালিজম অনুযায়ী বেশ কিছু বিশ্বাস রয়েছে যা হিউম্যান বিলিভ সিস্টেম এর মৌলিক বিশ্বাস বা কেন্দ্রীয় বিশ্বাস। এগুলোর জন্য আলাদা কোনো প্রমাণ প্রয়োজন হয়না। এই মতে বিশ্বাস হচ্ছে প্রপারলি বেসিক। এই বিশ্বাসগুলো নন ডক্সাটিক জাস্টিফিকেশানে হয়ে থাকে। এসব বিশ্বাসের জন্য কোনো জাস্টিফিকেশন বা প্রমাণ কিংবা অন্যান্য বিশ্বাসের প্রয়োজন নেই বা ফাউন্ডেশনাল বিলিভ অন্য বিলিভের উপর নির্ভরশীল নয়।মর্ডান ফাউন্ডেশনালিজম অনুযায়ী প্রপারলি বেসিক বিলিভ গুলো স্বতসিদ্ধ প্রমাণিত বা ইনকররিজিবল। [1]The incorrigibility of the cogito”, Johnathan Harrison, Mind: New Series, Vol. 93, No. XCIII, 1984.
উদাহরণস্বরুপ আমরা আমাদের এক্সটার্নাল মহাবিশ্বের কথা বলতে পারি। আমরা বিশ্বাস করে নেই মহাবিশ্বের অস্তিত্ব সত্য এমনকি বিজ্ঞানও বিশ্বাস করে নেয় মহাবিশ্ব সত্য। আমাদের ফিজিক্যাল রিয়েলিটি আমাদের মন এবং চেতনা থেকে আলাদা। আমরা পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে মহাবিশ্ব কে অনুভব করি তাই মহাবিশ্ব সত্য এমন ভাবার কোনো কারণ নেই কারণ এমনটা হতেই পারে যে আপনার মস্তিষ্ক কোনো ল্যাবরেটরিতে আছে এবং আপনাকে মেশিনারি ইনপুটের মাধ্যমে এসব দেখানো হচ্ছে ( সিমুলেশন আর্গুমেন্ট) আমাদের অভিজ্ঞতা আসলে আমাদের অস্তিত্ব বাস্তব এর পক্ষে কোনো রিজন বা প্রমাণ প্রোভাইড করে না। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে আমরা বেচে আছি, অন্যান্য মনের অস্তিত্ব আছে, আমাদের মহাবিশ্বের অস্তিত্ব বাস্তব এসব জিনিসের কোনো প্রমাণ আমাদের কাছে নেই বরং এগুলো আমাদের ফাউন্ডেশনাল বিশ্বাস বা এগুলো স্বতসিদ্ধভাবে প্রমাণিত। এমনকি আল্লাহর অস্তিত্ব ও স্বতঃসিদ্ধ প্রমাণিত। এটি ফিতরাতের অন্তর্ভুক্ত।
সমাজবিজ্ঞানগত, মনস্তাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক এমন অসংখ্য নানা ধরনের প্রমাণ রয়েছে স্রষ্টায় বিশ্বাস সহজাত এ নিয়ে। স্রষ্টা স্বতঃসিদ্ধ প্রমাণিত কিংবা তাঁর অস্তিত্ব মৌলিক বিশ্বাস এর মানে এই নয় সবাইকেই এটা বিশ্বাস করতে হবে বা মানতে হবে। বরং কোনো গোষ্ঠীর ঐক্যমত এটা প্রমাণে যথেষ্ট। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় পৃথিবীতে আস্তিকের সংখ্যা সর্বদাই নাস্তিকের তুলনায় বেশি ছিলো এখনো আছে। যদি বাই বর্ন মানুষ ফিতরাহ নিয়ে না জন্মাতো তবে এটা অসম্ভব ছিলো। আল্লাহর অস্তিত্ব মানুষের সহজাত বিশ্বাস হওয়ায় জন্ম থেকেই সকলে আস্তিক এবং যার ফলে ঐতিহাসিকভাবে সর্বদাই বিশ্বাসীদের সংখ্যা বেশি ছিলো আছে এবং থাকবে ইন শা আল্লাহ। মজার বিষয় হলো বিশ্বাসীদের মধ্যেই কেবল সহজাত বিশ্বাস রয়েছে এমন না যেহেতু বিশ্বাসটা সহজাত সেক্ষেত্রে সবার মধ্যেই তা বিদ্যমান, যেমন ওয়েস্টার্ন কান্ট্রির সেক্যুলার এডাল্টরাও (cognitively) সহজাত ভাবে প্রাকৃতিক জগৎ সম্পর্কে নকশাতাত্ত্বিক চিন্তাধারা লালন করে। [2]Roberts, A. J., Wastell, C. A., & Polito, V. (2020). Teleology and the intentions of supernatural agents. Consciousness and cognition, 80, 102905.https://doi.org/10.1016/j.concog.2020.102905মানবগোষ্ঠীর শুরুতে তারা জন্মগতভাবে আল্লাহর অস্তিত্ব কে ফাউন্ডেশন হিসেবে জেনে থাকে বলেই শুরুতে এবং এখন পর্যন্ত বিশ্বাসীদের সংখ্যা বেশি। রাসুল (ﷺ) বলেন, আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ প্রত্যেক সন্তানই ইসলামী ফিতরাতের উপর জন্মগ্রহণ করে থাকে। অতঃপর তার মাতা-পিতা তাকে ইয়াহুদী, নাসারা অথবা অগ্নিপূজক বানিয়ে ফেলে। ( সহিহ বুখারী ১৩৫৮)
Rational evidence: যৌক্তিক প্রমাণ
PSR অনুযায়ী সকল কিছুর একটি কারণ বা ব্যাখ্যা থাকা আবশ্যক। আমাদের মহাবিশ্বের অস্তিত্বের চারটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা রয়েছে তন্মধ্যে একটি সঠিক। ১. শুন্য থেকে ২. সেল্ফ ক্রিয়েশন ৩. সৃষ্ট কোনো কিছু থেকে ৪. অসৃষ্ট কোনো কিছু থেকে। শুন্য থেকে কোনো কিছু কোনো কারণ ব্যতীত অস্তিত্বে আসা অসম্ভব এটি আমরা ইন্টুইটিভ ভাবেই জানি, রিয়েলিটি কেবল শুন্য থেকে আসতে পারে না। দ্বিতীয়ত সেল্ফ ক্রিয়েশন অসম্ভব এটি law of noncontradiction কে ভায়োলেট করে। অন্যদিকে সৃষ্ট কোনো কিছু থেকে মহাবিশ্ব অস্তিত্বে আসলে ওই সৃষ্ট বস্তুর ও ব্যাখ্যার প্রয়োজন এভাবে একের পর এক অসীম সংখ্যক কারণ থাকা অসম্ভব, তাই মহাবিশ্ব সৃষ্ট কোনো কিছু থেকে এসেছে এটাও বাতিল। [3]Loke, A. T. E. (2012). Is an infinite temporal regress of events possible?. Think, 11(31), 105-122.https://doi.org/10.1017/S1477175612000061সুতরাং বাকি থাকে একটি তা হচ্ছে অসৃষ্ট কোন কিছু থেকে মহাবিশ্ব অস্তিত্বে এসেছে। এবং যেহেতু মহাবিশ্ব কে সৃষ্টি করা হয়েছে সেক্ষেত্রে তৈরি করার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা আবশ্যক, সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য চেতনা থাকা আবশ্যক তাই সেই কারণটি কনশাস কারণ এবং যেহেতু কনশাস বা চেতনাসম্পন্ন সুতরাং সেই কারণ কোনো বস্তু নয় বরং একজন সত্তা এবং তিনি হলেন স্রষ্টা। [4]দ্য গড হাইপোথিসিস A case for the existance of Allah, আসিফ মেহেদী, p.78 https://link.boitoi.com.bd/M2N4
True God: সত্য ঈশ্বর
একজন সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব রয়েছে জানার পর আমাদের জানা প্রয়োজন তিনি আসলে কে? পৃথিবীতে প্রায় ৪৩০০ এর অধিক ধর্মের ঈশ্বর রয়েছে কে প্রকৃত ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তা? এটি যাচাই এর জন্য আমরা আরেকটি ধাপ বিবেচনা করতে পারি, সেটি হচ্ছে ঈশ্বরের সত্য প্রকৃতি। যদি একজন স্রষ্টা থাকেন তবে তাঁকে এক ও অদ্বিতীয় হতেই হবে। অর্থাৎ এটা যুক্তিগতভাবে অবশ্যম্ভাবী বা লজিক্যাল নেসেসিটি। স্রষ্টার বৈশিষ্ট্য বা প্রকৃতি নিয়ে যে মতবাদ গুলো রয়েছে তা হলো মনোথিজম (একত্ববাদ), পলিথিজম ( বহুঈশ্বরবাদ), প্যান্থিজম ( সর্বেশ্বরবাদ) ইত্যাদি। মনোথিজম বা একত্ববাদ অনুসারে ঈশ্বর কেবল এক ও অদ্বিতীয়, তিনি সকল উত্তম গুণে উত্তমরুপে গুনান্বিত, তিনি শাশ্বত এবং সৃষ্টি থেকে আলাদা। অন্যদিকে প্যান্থিজম অনুযায়ী ঈশ্বর এবং মহাবিশ্ব ভিন্ন কিছু নয় বরং মহাবিশ্ব ঈশ্বরের একাংশ, এবং অন্তরর্নিহিত৷ তবে ঈশ্বরের সংজ্ঞানুযায়ী প্যান্থিজম বাতিল হয়ে যায় যা টিকে থাকে তা হলো ন্যাচারালিস্টিক প্যান্থিজম, এই মত অনুসারে ঈশ্বরের পরিবর্তে প্রকৃতি বা ন্যাচারকেই অনন্ত হিসেবে ধরে নেয়া হয়। যদিওবা মহাবিশ্ব অনন্ত অসীম নয় বরং তা সম্ভাব্য অস্তিত্ব তাই এই ধারণাটিও বাতিল করে দিতে হচ্ছে।[5]Guth, A. H. (2007). Eternal inflation and its implications. Journal of Physics A: Mathematical and Theoretical, 40(25), 6811https://doi.org/10.1088/1751-8113/40/25/S25অন্যদিকে পলিথিজম বা একের অধিক ঈশ্বর লজিক্যালি সম্ভব নয়। যেমন ধরুন, যদি দুইজন স্রষ্টা থাকে তবে তাদের মধ্যে অবশ্যই কিছু পার্থক্য থাকবে। পার্থক্য থাকলেই না আমরা কোনো কিছু কে অন্য একটি বিষয় থেকে আলাদা করতে পারি। উদাহরণস্বরুপ, ধরুন দুটো গাছ আছে। সেক্ষেত্রে দুটো গাছের আকার, আকৃতি, রং ইত্যাদির পার্থক্য অবশ্যই থাকবে যার দরুন আপনি বুঝতে পারবেন যে গাছ দুটো আসলে আলাদা। এমনকি যদি গাছ দুটো আইডেন্টিক্যাল ও হয় তবুও এর কিছু পার্থক্য থাকবে। যমজ বাচ্চাদেএ ক্ষেত্রেও ৯৯% মিল থাকলেও কিছু পার্থক্য থাকবেই যার ফলে আমরা তাদের আলাদা করতে পারব। এবার একই বিষয়টি স্রষ্টার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যাক। ধরুন X একজন স্রষ্টা এবং Y আরেকজন স্রষ্টা। এখন Y হচ্ছেন সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ, এবং X নিজেও সর্বশক্তিমান এবং সর্বজ্ঞ। তাহলে ঈশ্বর আসলে কয়জন? একজন ই। আবার যদি ধরে নেই ঈশ্বর একের অধিক তবে দুজন ই যদি সর্বশক্তিমান হয় এবং দুটো একই সাথে একচুয়ালাইজড হতে হয় তবে তা দ্বন্দ্ব তৈরি করে সুতরাং স্রষ্টা কেবল একজনই। অর্থাৎ যুক্তিসংগত ভাবে একত্ববাদ ই কেবল সত্য হতে পারে।
৩. Ultimate God:
আমরা দেখলাম স্রষ্টার অস্তিত্ব সত্য, এবং তিনি যে এক ও অদ্বিতীয় সেটাও সত্য অন্যান্য মতবাদ যুক্তিসংগত ভাবে অসম্ভব এবং মিথ্যে। এবার ট্র্যাডিশনাল ধর্মগুলো যেমন ইসলাম, খ্রিস্টান, হিন্দু, ইহুদি এই ধর্মগুলো নিজেদের ঈশ্বর কে ইউনিটিরিয়ান দাবি করলেও ইসলাম বাদে বাকিধর্মে ঈশ্বরের ধারণা খুব বাজেভাবে বিকৃত। যেমন হিন্দুধর্মে ঈশ্বরের ধারণা বেশ কমপ্লেক্স এবং এটি কেবল এক ঈশ্বরের বর্ণনা দেয়না বরং পলিথিজম, প্যান্থিজম এর মতো বিকৃত মতকেও এন্ডোর্স করে, অন্যদিকে খ্রিস্টানরাও ট্রাই পার্সোনাল গড কে এক দাবি করে যা আসলেই সমস্যাযুক্ত, [6]Branson, B. (2014). The logical problem of the trinity (Doctoral dissertation, University of Notre Dame).https://philarchive.org/archive/BRATLP-3এছাড়াও মডার্ণ ইহুদিরা মনোথিইস্টিক হলেও অষ্টম শতকের পূর্বে এরা পলিথিইস্টিক ছিলো। [7]Albertz, Rainer (1994). A History of Israelite Religion, Volume I: From the Beginnings to the End of the Monarchy. Westminster John Knox. p. 61. উপধর্মগুলোকে যাচাই করলেও একই সমস্যা দেখা যায় যেহেতু সেগুলো মিশ্র ধর্ম। পূর্নাঙ্গ একত্ববাদী ধর্ম কেবল একটাই যা ইসলাম। যেমন আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেন,
বল: তিনিই আল্লাহ একক/অদ্বিতীয়। ( সুরা ইখলাস:০১)
قُلۡ ہُوَ اللّٰہُ اَحَدٌ ۚ﴿۱﴾
আল্লাহ সব দিক থেকে এক’ -এর দ্বারা أحد শব্দের তরজমা করার চেষ্টা করা হয়েছে। কেবল ‘এক’ বললে এর সম্পূর্ণ মর্ম আদায় হয় না। সব দিক থেকে এক’-এর ব্যাখ্যা এই যে, তাঁর সত্তা এক। তাঁর কোন অংশ নেই, খণ্ড নেই। তাঁর গুণাবলীও এমন যে, তা আর কারও মধ্যে পাওয়া যায় না। এভাবে তিনি নিজ সত্তার দিক থেকেও এক, গুণাবলীর দিক থেকেও এক। অর্থাৎ একজন সত্য ঈশ্বর এবং মহান আল্লাহ তায়ালার প্রকৃতি একই, যার ফলে বোঝা যায় একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই সত্য মা’বুদ।
কুরআনের সত্যতা
আল কুরআনের বিস্ময়কর মুজিযা:
উপক্রমনিকা (Introduction) আল্লাহ তায়ালা সকল নবি-রাসুলকে অলৌকিক বস্তু দান করেছেন তাদের যুগোপযোগী করে এবং তা ছিলো ক্ষণস্থায়ী।আর মহানবি হযরত মুহাম্মদ (স.) -এর মু’জিযার যুগ কেয়ামত পর্যন্ত বিস্তৃত। এ কারণে তাঁর মু’জিযাও শাশ্বত ও চিরন্তন। আর আল কুরআন হলো তার শ্রেষ্ঠতম মু’জিযা। এ কিতাবের মু’জিযার চিরন্তনতা বিভিন্নমুখী।
‘মানাহিলু’ল -‘ইরফান’ গ্রন্থে কুরআনের চিরন্তন মু’জিযা সম্পর্কে বলা হয়েছে যে,“আমরা কুরআনের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে দেখতে পাই,বহু মু’জিযা-সংবলিত আল কুরআন চিরন্তন। যুগপরিক্রমায় তা বিলুপ্ত হয়নি এবং রাসুলুল্লাহ (স.)-এর ইন্তেকালেও তা বিন্দু মাত্র পরিবর্তিত হয়নি।পবিত্র কুরআনের মু’জিযার কারণ ও দিকসমূহ (Reasons and aspects of Muziza in the Quran) :মহাগ্রন্থ আল কুরআন নিঃসন্দেহে বিশেষ অলৌকিক বৈশিষ্ট্যমন্ডিত ও মু’জিযাসমৃদ্ধ গ্রন্থ। এক্ষেত্রে মানবিক যোগ্যতা ও দক্ষতা সম্পুর্ণ বিকল ও ব্যর্থ। এর মু’জিযার মোকাবিলা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা অসম্ভব। কেননা এ গ্রন্থের মু’জিযা বিভিন্নমুখী।
“আল্লামা তাক্বী”উসমানী কোরআনের মু’জিযাকে চারভাগে ভাগ করেছেম। যেমন (১) শাব্দিক মু’জিযা (২) বিন্যাসগত মু’জিযা (৩) পদ্ধতিগত মু’জিযা (৪) গাথুনিগত মু’জিযা।
মু’জিযা-সংক্রান্ত বিষয়ে ইসলামি পন্ডিত ও চিন্তাবিদদের মধ্যে বিভিন্ন মতবাদ রয়েছে।“আল্লামা কাযী ‘আয়ায (রহ.) বলেন, এর চুড়ান্ত মু’জিযা চারটি। আবার কুরতুবী (রহ.) বলেন, এর মু’জিযার সংখ্যা ১০টি। আবার অনেকের মতে, এর মু’জিযার সংখ্যা ৬০ টি।
‘আল্লামা ইবন সুরাকাহ-এর মতে, আল কুরআন এর মু’জিযার সংখ্যা হাজার হাজার। তন্মধ্যে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ ও বিস্ময়কর মু’জিযার কারণ ও দিক নিম্নে বর্ণিত হলো :
১) ভাষার অলংকার ও রচনাশৈলী তথা বালাগত ও ফাসাহাত(Ornaments and Contexture of the Language)
মহাগ্রন্থ আল কুরআন মু’জিযা হওয়ার অন্যতম কারণ ও দিক হচ্ছে, এর উন্নত মানের সাহিত্যিক অলংকারপূর্নতা, অনুপম রচনাশৈলী এবং নির্ভুল বাক্যের গাথুনি।’আল্লামা রাফে’ঈ তার ‘ই’জাযু’ল-কুরআন’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে, আল কুরআন ফাসাহাত এবং বালাগাতের মাধ্যমে বিশেষ বৈশিষ্ট্য মন্ডিত এবং এটা তিন পদ্ধতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। যেমন :(১) কুরআনের শাব্দিক ফাসাহাত (২) অর্থের ভিত্তিতে বালাগাত এবং (৩) শব্দবিন্যাস পদ্ধতির দৃষ্টিকোণে ফাসাহাত।এসব বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে উপলব্ধি করা যায় যে, এ গ্রন্থের সমগ্রটাই হলো মু’জিযা। এ গ্রন্থের অনুপম রচনাশৈলী ‘আরবদের রচনাশৈলী থেকে সম্পূর্ণ ভিন্নতর। এটা কোনো গদ্যও নয়, আবার কোনো পদ্যও নয়। সাহিত্যশৈলীর বিচারে কুরআনের কোনো অন্ত্যমিল ও ছন্দের ওজন নেই,যা কবিতার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।আবার অছন্দ পদ্ধতির গদ্যও এটা নয়।বরং এ-গ্রন্থ হচ্ছে গদ্য ও পদ্যের মিশ্রণে বিশুদ্ধতম রচনা। এটাই হচ্ছে এ -গ্রন্থের মু’জিযা হওয়ার অন্যতম কারণ ও দিক।
২. অসংখ্য ভবিষ্যতবানী ও অদৃশ্য তথ্য পরিবেশন (Serving numerous predictions and invisible information)
মহাগ্রন্থ আল কুরআন মু’জিযা হওয়ার গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে, এ গ্রন্থটি অদৃশ্য জগতের অনেক খবরদারি,বিগত যুগের অসংখ্য ও অগনিত কাহিনি উল্লেখ করেছে।এমন সব অদৃশ্য রহস্যের বর্ণনা ও ভবিষ্যতবানীর ভিত্তি একমাত্র ওহি ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। এ গ্রন্থে ঘোষিত ভবিষ্যতবানী হুবহু অক্ষরে অক্ষরে সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে; একবিন্দু ও পরিবর্তন হয়নি।
৩) জাদুকরী আকর্ষণ, প্রভাব এবং সম্মোহনী শক্তি (Magical attraction, impact and hypnotic power)
পবিত্র কুরআনের আকর্ষণ ও প্রভাবশক্তি মু’জিযা হওয়ার অন্যতম কারণ। এ গ্রন্থের গাম্ভীর্যময় উচ্চারণ, ভাবগভীরতা,অলৌকিক, অতুলনীয় জাদুকরী সম্মোহনী শক্তিই হচ্ছে এর মৌলিক উপাদান। এ কিতাব তিলাওয়াতের সময় মানবীয় অন্তর বিগলিত হয়ে যায়। এর ভাষা, অলংকার,ছন্দ,রস ইত্যাদির অপূর্ব মধুময় ঝংকারে মানবহৃদয় স্বর্গীয় অনুভূতিতে ব্যাকুল হয়ে পড়ে। কালপরিক্রমায় এ-গ্রন্থের অমিয়বানীর ফলগুলো মানুষের মতে দাগ কেটেছে। এর আকর্ষণ ও সম্মোহনী শক্তি দিয়ে মানুষ কে তার প্রতি আকৃষ্ট করেছে। একমাত্র কুরআনের পবিত্র বানী শ্রবণ করেই অনেক কাফির আর অসংখ্য দুশমনই ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছে। অসংখ্য মানুষ বিশ্বনবি হযরত মুহাম্মদ (স.) -এর সুললিত কন্ঠে ও পবিত্র মুখঃনিসৃত মধুময় তিলাওয়াত শ্রবণ করে ইসলামের দীক্ষা গ্রহণ করেছে। ইসলামের ইতিহাস তথা আল কুরআন এর ঐতিহাসিক পটভূমিকায় রয়েছে এ ধরনের প্রচুর দৃষ্টান্তের অপূর্ব সমাবেশ। এক্ষেত্রে যুবায়ের ইবন মুত’ইম, কায়স ইবন নাসিরা,হযরত উছমান ইবনে মায’উন, হযরত সুয়েদ ইবনে সামিদ, যামাদ আযাদী, লবীদ ইবনে রাবিয়াহ, নাবিগাহ আহজাদী, প্রমুখ মনীষীর নাম উল্লেখযোগ্য। এ সকল ব্যক্তি পবিত্র কুরআনের মর্মস্পর্শী ধ্বনি, মধুমাখা বাক্যের সৌন্দর্য ও সুমিষ্ট আয়াতসমূহে মোহিত ও বিস্মায়াভিভূত হয়ে পড়ত। এমনকি কত মানুষ এর অনবিল ঐকতানে আকৃষ্ট হয়ে, মোহবিষ্ট মন্ত্রমুগ্ধের মতো এ-র তিলাওয়াত শুনে অতৃপ্ত আত্মাকে পরিতৃপ্ত ও শান্ত করত।
৪)প্রাচীন জাতিগোষ্ঠী ও জনপদের বর্ণনা (Description of Ancient Population and Towns)
প্রাচীন জাতিগোষ্ঠী ও জনপদের বিস্তারিত আলোচনা, সঠিক ইতিহাস, উউত্থান-পতনের মর্মস্পর্শী ঘটনাবলি এবং কাহিনীর উপস্থাপনা হচ্ছে পবিত্র কুরআনের অন্যতম মু’জিযা। কেননা এ গ্রন্থ বিভিন্ন জনপদ, জাতি, সভ্যতার উন্নতি ও অবনতি,উৎকর্ষ ও ধ্বংসের হৃদয়গ্রাহী বিবরণ বিস্তারিত ও পরিপূর্ণ তথ্য-সহকারে তুলে ধরেছে। এসব এসব সুদৃঢ় তথ্যসংবলিত কাহিনি ও ঘটনার বিবরণ এমন এক ব্যক্তি উপস্থাপন করেছেন, যিনি কোনো কবি,সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিক নন এবং বিগত কোনো ঘটনা সম্পর্কে তিনি অবহিত ছিলেন না।
৫) হুরুফে মুকাত্তা’আত তথা বিচ্ছিন্ন বর্ণ ( Detached Letter)
পবিত্র কুরআনের মহাবিস্ময়কর মু’জিযা হচ্ছে, এ গ্রন্থে বর্ণিত কতিপয় সূরার প্রারম্ভে ব্যবহৃত হুরুফে মুকাত্তা’আত(বিচ্ছিন্ন বর্ণগুলো), যার ব্যাখ্যা ও গুরুত্ব, তাত্ত্বিক রহস্য ও সুস্পষ্ট বিশ্লেষণ মানুষের স্বল্প জ্ঞানের চিন্তাবহির্ভূত ও সাধ্যাতীত ব্যাপার। এর প্রকৃত ব্যাখ্যা একমাত্র আল্লাহ তা’য়ালা অবহিত আছেন। ‘তাফসীরে ফাতহু’ল-কাদীর ‘ গ্রন্থে বলা হয়েছে, “এটাই আল্লাহর গোপন রহস্য।প্রত্যেক আসমানি গ্রন্থেই আল্লাহর গোপন রহস্য বিদ্যমান এবং এটা মুতাশাবিহির অন্তর্ভুক্ত। ” সুতরাং হুরুফে মুকাত্তা’আত আল-কুরআনের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মু’জিযার অধিকারী। ‘আল্লামা বাকিল্লানী (রহ.) বলেন, এর অন্তর্ভুক্ত মোট হরফের সংখ্যা ২৯টি এবং এর মধ্যে হুরুফে মুকাররার মোট ১৪টি।’
৬) ভাষার সাবলীলতা ও অলংকার (Fluency and Ornaments of language)
পবিত্র কুরআনের আরেকটি মু’জিযা হলো ভাষার সাবলীলতা ও অলংকার সর্বত্র সমানভাবে বিদ্যমান। সমগ্র কুরআন খুঁজে কোথাও এমন একটি আয়াতও পাওয়া যাবে না যার ভাষা সাবলীল নয়। কিন্তু কোনো মানুষের পক্ষে এটা সম্ভবপর নয় যে, তার বক্তব্যের শুরু হতে শেষ পর্যন্ত সর্বত্র ভাষার সুললিত সৌকুমার্য, সাবলীলতা বা অলংকার সমানভাবে বিদ্যমান
৭) বাচনভঙ্গির অভিনবত্ব (Modern Utterance)
এটা স্বতঃসিদ্ধ যে, আল কুরআনের বর্ণনারীতি ও বাচনভঙ্গি অন্যান্য ভাষাবিদ ও অলংকারবিদদের বর্ণনারীতি হতে সম্পূর্ণ অভিনব ও বিস্ময়কর। আয়াতের সমাপ্তি ও মিলনবিন্যাস সম্পূর্ণ নতুন ধরনের। কুরআনের পুর্বে অন্য কোনো রচনায় যেমন এর নজির পাওয়া যায় না, তেমনি এ গ্রন্থের পরবর্তী কোনো গ্রন্থেও এর নমুনা পরিদৃষ্ট হয় না এবং হবেও না।এর এ অভিনব ও অপূর্ব বাচনভঙ্গি দেখে ‘আরব ভাষাবিদগণ বিস্মিত ও আকর্ষিত হয়ে কুরআনের আদর্শে উজ্জীবিত হয়েছিলেন। মুফাসসিরীন, ফুকাহা ও আলেমগণের মতে, আল-কুরআনের বর্ণনাশৈলীও একটি মু’জিযা।
৮) শব্দগত মু’জিযা (Literary Muziza)
পবিত্র কুরআনের শব্দচয়নে এমন অভূতপূর্ব রীতি গ্রহণ করা হয়েছে, যা মানবীয় শক্তি-সামর্থ্যের বহির্ভূত। যেমন এ গ্রন্থে এমন কিছু শব্দ আছে, যেগুলো শুধু বহুবচন রুপেই ব্যবহৃত হয়। উদাহরণস্বরুপ:আল-আলবাব, আল-কাওয়াকিবু, আল-আরজা প্রভৃতি শব্দসমূহ।কুরআনের সব জায়গায় এ শব্দগুলো বহুবচন হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু অপরদিকে, আল-আরদু শব্দটি একবচন রুপে ব্যবহৃত হয়েছে এবং কুরআনের আল-মাউতু ও আত- তাওয়াফফা শব্দদ্বয়ের তাত্ত্বিক প্রয়োগ পদ্ধতিতেও মু’জিযা বিদ্যমান। এ গ্রন্থের প্রতিটি শব্দই প্রকাশ করে থাকে তার সুনির্দিষ্ট ও সার্থক অর্থ।অতএব বলা যায় যে, এ গ্রন্থে বর্ণিত শব্দগুলো যেন একটা অঙ্গবিশেষ, আর অর্থ হচ্ছে এর রুপ তথা আত্মা।
৯) মুখস্থকরণে সহজলভ্যতা(Smoothness in Memorization)
পবিত্র কুরআন মু’জিযা হওয়ার অন্যতম কারণ ও দিক হচ্ছে এর ভাষা বোঝা,উপলব্ধি করা, স্মরণ রাখা এবং মুখস্তকরণের সহজলভ্যতা। এ মহামান্বিত গ্রন্থের ভাষা এতই প্রাঞ্জল ও মোহনীয়, যার অর্থ না-বুঝেও আদ্যোপান্ত অনায়াসে মুখস্ত করে নেওয়া যায়। একমাত্র এ-কারণেই আজ বিশ্বের অন্য কোনো গ্রন্থের নয় বরং শুধু আল্লাহর নাযিলকৃত আল কুরআনেরই লক্ষ লক্ষ সম্মানিত হাফেয রয়েছেন। সুতরাং এটা নিঃসন্দেহে একটি আসমানি গ্রন্থ এবং হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর একটি জীবন্ত মু’জিযা।
১০) বিষয়সমূহের মধ্যে বিরোধ ও বিভ্রান্তি না থাকা(Absence of Dispute and confusion in matters)
আল কুরআনের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা, গাম্ভীর্যপূর্ণ শব্দ, প্রাঞ্জল, সাবলীল, স্বচ্ছ ও সংগতিপূর্ণ আয়াতের মাধ্যমে বহু বিষয়ের আলোচনা করা হয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে কোনোরুপ নুন্যতম বিরোধ, বিভ্রান্তি, জড়তা,কমতি,মাত্রাতিরিক্ততা,বৈপরীত্য-মতভেদ পরিলক্ষিত হয় না। এটা মানুষের বর্ণনার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। অর্থগত-শব্দগত উভয় দিক থেকে এটি পূর্ণসামঞ্জস্যশীল। এটাই হলো কুরআনের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ মু’জিযার একটি।
১১) স্থায়িত্ব ও চিরন্তনতা(Stability and Immortality)
আল কুরআন মু’জিযা হওয়ার অন্যতম আরেকটি কারণ ও দিক হচ্ছে এটা কোনো সাময়িক বা আকস্মিক মু’জিযা নয় বরং এটা শাশ্বত এবং চিরন্তন একটি মু’জিযা। অনন্তকাল পর্যন্ত এ গ্রন্থ অনন্যসাধারণ মু’জিযাগ্রন্থ হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত থাকবে। এ মু’জিযার উপর কালের কোনো প্রভাব প্রতিফলিত হবে না। কালের গতিধারা কুরআনের মু’জিযার গুরুত্বকে হ্রাস করতে পারবে না এবং এর কল্যাণকারিতাকেও কমাতে পারবে না ভাষার অলংকার ও সাবলীলতা এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের যত উন্নতিই হোক না কেন, এ কিতাবের রুপগত, অর্থসংক্রান্ত মু’জিযা এবং অলৌকিকতার কোনো দুর্বলতা অনুভূত হবে না। ফলে এর শব্দ,বাক্য এবং অর্থসহ কোনো কিছুর মধ্যে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন এবং কোনো অতিরঞ্জন প্রবেশ করবে না।
১২) পুনঃপুন পাঠের স্বাদ ও আকর্ষণ (The Taste and Attraction of Repeated Reading)
কোনো রচনা যতই সাবলীল ও অলংকারপূর্ণই হোক না কেন, মানুষ সেটাকে একবার পড়া অথবা শোনার পর দ্বিতীয় বার সেটাকে শুনতে বা পড়তে আগ্রহান্বিত হয় না বরং এটার প্রতি একপ্রকার বিতৃষ্ণার সৃষ্টি হয়। কিন্তু পৃথিবীতে একমাত্র গ্রন্থ হলো আল কুরআন যা বারংবার পাঠ করা বা শোনার পর নতুন আনন্দ বা পুলক এবং হৃদয়ের স্পন্দন লাভ করা যায়। অনবরত তিলাওয়াত করলেও মানুষের মনে কোনো বিরক্তির সৃষ্টি হয় না ; বরং যত বেশি পাঠ করা হয়,ততই তার প্রতি আগ্রহ ও ব্যাকুলতা বাড়তে থাকে। শুধু তাই নয়, অন্যের তিলাওয়াত শুনলেও মনে গভীর তন্ময়তা ও অপরিমেয় আগ্রহ জন্মায়। এটাই হলো পবিত্র কুরআনের মু’জিযা তথা অলৌকিকতা।
১৩) অপূর্ব গ্রন্থাবদ্ধতা ও অভূতপূর্ব সংরক্ষণ পদ্ধতি (Wonderful Book Format and Unprecedented Preserving Method)
আল কুরআনের বিস্ময়কর গ্রন্থাবদ্ধতা এবং অভূতপূর্ব সংরক্ষণ পদ্ধতি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। বিশ্বে পুরাতন ধর্মীয় গ্রন্থ গুলোর মধ্যে যেগুলো আজও বিদ্যমান, তার মধ্যে এ গ্রন্থই বিশেষ বৈশিষ্ট্যে সমৃদ্ধ। এর লিপিবদ্ধকরণ ও গ্রন্থাবদ্ধতার কৌশল এবং সংরক্ষণ পদ্ধতি প্রকৃতই অলৌকিক ও মু’জিযাপূর্ণ। এর বর্ণনার ধরন ও পদ্ধতি ম সাধারণ মানবীয় বর্ণনার ধরন-বিবর্জিত। এর কোনো তুলনা নেই।
১৪)সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়াদির বর্ণনা (The description of The Small and The Slightest Matter):
আল কুরআন মহাসত্যের অকাট্য প্রমাণস্বরুপ। আবার এটাও স্বয়ং প্রমাণিত সত্য। এর শব্দের বিন্যাস, ছন্দময় অপূর্ব মিলন, বাক্যের জাদুকরী উৎকর্ষ ইত্যাদির মধ্যে আল্লাহর সৃষ্টি রহস্যের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়সমূহের আলোচনা এসেছে। এজন্যে সমকালীন ‘আরবের পন্ডিত, ভাষাবিদ ও সাহিত্যিকরা তাদের ভাষা প্রয়োগের মাধ্যমে কুরআনের জবাব দিতে ব্যর্থ হয়েছিলো। কারণ এ গ্রন্থে তাশবীহ, ইসতিআরাহ,ইজায ও তামছিল ইত্যাদির মাধ্যমে অসংখ্য সুক্ষ্ম বিষয় বর্ণনা করেছে ; যা তাদের পক্ষে ছিলো অসম্ভব। এটাই হলো কুরআনের অন্যতম মু’জিযা।
১৫) চারিত্রিক ও আধ্যাত্মিক বিপ্লব সাধন(Characteristic and Spiritual Revolution) :
আল কুরআন এর সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ মু’জিযা এই যে, এটা বর্বর ও জাহিল-মুর্খ ‘আরবদের মধ্যে চারিত্রিক ও আধ্যাত্মিক বিপ্লব সাধন করে তাদের সভ্যতা ও মনুষ্যত্বকে উন্নতির চরম শিখরে উন্নীত করেছিল। তাদের একটি পৃথক সাম্রাজ্য, একটি পূর্নাঙ্গ বিধান ও একটি পূর্নাঙ্গ শরি’আত প্রদান করেছিল। এ গ্রন্থের ভাষাকে একটি চিরন্তন ও বিশ্বজনীন ভাষার মর্যাদা প্রদান করেছিল।আবু ইয়াকুব আস-সাক্কাকী (রহ.) বলেন, আল কুরআনের মু’জিযার ব্যাখ্যা তথা বিশ্লেষণ সম্ভবপর নয়।এটা উপলব্ধি করা যায় কিন্তু সুষ্ঠুভাবে বিশ্লেষণ করা যায় না। যেমন :কোনো শব্দরুপের বিশুদ্ধতা অনুভব করা যায় কিন্তু এটা ভাষায় সম্যক বর্ণনা করা যায় না। তেমনি কোনো কোনো জিনিসের সৌন্দর্য উপলব্ধি করা যায় কিন্তু এটা প্রকাশ করা এতো সহজ নয়। ভাষা সাহিত্য ও অলংকারশাস্ত্রে বুতপত্তি অর্জনের এবং সুস্থ অনুভূতির ভিত্তিতে কুরআনের মু’জিযা উপলব্ধি করা যায়। আসলে পবিত্র কুরআনের প্রত্যেকটি বিষয়ই মু’জিযা। আল্লাহর কিতাবের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য, গূঢ় তত্ত্ব ও রহস্যের জ্ঞানার্জন এবং অনুধাবন করা মানুষের শক্তিবহির্ভূত ব্যাপার। এজন্য এ গ্রন্থের সমতুল্য একটি আয়াত ও সমগ্র মানবজাতি তৈরি করতে পারবে না।
উপসংহার (Conclusion): উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, মহাগ্রন্থ কুরআনুল কারিম একটি অলৌকিক গ্রন্থ যা মহান আল্লাহর নাযিলকৃত। এটি সকল জ্ঞানের চূড়ান্ত আধার। এর সত্যতা স্বীকার করে বসওয়ার্থ স্মিথ (Bosworth Smith) এ প্রসঙ্গে বলেন,“The Quran is a book which is poem, a code of laws, a book of common prayer, all in one and is reverenced by a large section of human race, as miracle of purity of style, of wisdom and truth. It is a miracle claimed by Muhammad (sm.), his standing miracle He called it and miracle indeed it is. – আল কুরআন এমন একটি গ্রন্থ, যা একাধারে কাব্যগ্রন্থ, আইনশাস্ত্র, প্রার্থনা পুস্তক এবং আজও পৃথিবীর এক পঞ্চমাংশ অধিবাসী যাকে নিখুঁত রচনাকৌশল, জ্ঞানগর্ভতা ও সত্য জ্ঞানের প্রেরণার দিক দিয়ে অলৌকিক বলে শ্রদ্ধা করেন। [8]Noman Daniel, Islam and the west, p.72-77 [9]Mr.Maim al Humeri, The history of the idea of the Izaz of the Quran, p.27
নবুয়তের সত্যতা:
আমরা দেখেছি একজন স্রষ্টা রয়েছেন, অতঃপর কেন আল্লাহই একমাত্র সত্য ঈশ্বর হতে পারেন তা নিয়ে আলোচনা করেছি, পরবর্তীতে ঐশ্বরিক গ্রন্থ কুরআনের অপরিবর্তনীয়তা এবং এর সত্যতা নিয়ে কথা বলেছি। এবার আমরা মুহাম্মদ (ﷺ) এর নবুয়ত এর সত্যতা নিয়ে আলোচনা করব। আমরা এক্ষেত্রে এটি আর্গুমেন্ট আকারে ব্যাখ্যা করতে পারি।
১. হয় মুহাম্মদ (ﷺ) ছিলেন মিথ্যেবাদী, বিভ্রান্ত (নাউজুবিল্লাহ) বা সত্যবাদী।
২. মুহাম্মদ (ﷺ) মিথ্যেবাদী কিংবা বিভ্রান্ত ছিলেন না।
৩. সুতরাং মুহাম্মদ (ﷺ) সত্যবাদী ছিলেন এবং যা বলেছেন তা সত্য হওয়া আবশ্যক।
যুক্তির প্রথম অংশটি নিয়ে কারো দ্বিমত থাকা অসম্ভব। কেননা একজন মানুষ হয় সত্য বলবে কিংবা তার লাভের জন্য মিথ্যে বলবে বা হয়তো সে বিভ্রমে থাকতে পারে। আমরা এই অনুসিদ্ধান্ত গুলো বিবেচনা করে দেখব।
মুহাম্মদ (ﷺ) কি মিথ্যেবাদী ছিলেন?
মুহাম্মদ (ﷺ) এর সত্যবাদীতা এবং সত্য দ্বীন প্রচারে তাঁর ত্যাগের কথা ইসলামের শত্রুদের ও অজানা নয়। এক্ষেত্রে একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। ইমাম বুখারী রাহ. সহীহ বুখারীতে হিরাক্লিয়াসের সাথে আবু সুফিয়ানের সাক্ষাৎ ও কথোপকথনের বিখ্যাত ঘটনা বর্ণনা করেছেন, আবু সুফিয়ান তখনো ইসলাম কবুল করেননি। তিনি ব্যবসার উদ্দেশ্যে শামে গিয়েছিলেন। শাম ঐ সময় বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল, সম্রাট কোনো কারণে শামে অবস্থান করছিলেন। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমনের সংবাদ তার নিকট পৌঁছেছিল। তিনি বিষয়টি সম্পর্কে আরো জানতে চাচ্ছিলেন। তো আদেশ দিলেন, এখানে যদি আরবের কেউ থাকে তাকে আমার কাছে নিয়ে আস, আমি আরবের নবী সম্পর্কে কিছু জানতে চাই। আবু সুফিয়ান শামে ছিলেন, তাকে হিরাক্লিয়াসের সামনে হাজির করা হল। হিরাক্লিয়াস অনেকগুলো প্রশ্ন করলেন। এর মধ্যে একটি প্রশ্ন ছিল-
فَهَلْ كُنْتُمْ تَتهِمُونَهُ بِالكَذِبِ قَبْلَ أَنْ يَقُولَ مَا قَالَ؟
তিনি নবুওতের দাবি করার আগে তোমরা কি কখনো তাকে মিথ্যাকথনে অভিযুক্ত করেছ?
আবু সুফিয়ান বলেন, আমি উত্তরে বললাম, না, এমন অভিজ্ঞতা আমাদের কখনো হয়নি; আমরা তাকে মিথ্যাবাদিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করতে পারিনি।
হিরাক্লিয়াস যে বিষয়গুলো জানতে চেয়েছিলেন সে সম্পর্কে আবু সুফিয়ানের উত্তর শোনার পর তিনি নিজেই একে একে সেই প্রশ্ন ও উত্তরগুলো বিশ্লেষণ করেছেন। সত্যবাদিতা সংক্রান্ত প্রশ্নের ব্যাপারে বললেন, আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করেছি, তোমরা কি তাকে নবুওত দাবির আগে মিথ্যাবাদিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করতে পেরেছ? তুমি বলেছ, অভিযুক্ত করতে পারোনি। এ থেকে আমি বুঝতে পেরেছি, তিনি সত্য নবী। কারণ যে ব্যক্তি মানুষের ব্যাপারে মিথ্যা বলেন না, তিনি আল্লাহর ব্যাপারেও মিথ্যা বলতে পারেন না। [10]সহিহ বুখারী হাদিস ৭
এটি হচ্ছে তাঁর সম্পর্কে এমন এক ব্যক্তির সাক্ষ্য, যিনি ঐ সময় পর্যন্ত তাঁর প্রাণের দুশমন ছিলেন এবং তার মর্যাদাহানীর সুযোগ খুঁজছিলেন। এটি স্বীকৃত যে নবীর শত্রুতাও তাকে বিশ্বাসী হিসেবে জানতেন। [11]Lings, M. (1983). Muhammad: His Life Based on the Earliest Sources, p. 34.
মুহাম্মদ (ﷺ) কি বিভ্রমে ছিলেন?
টেমকিন তার “The Falling Sickness” বইয়ে থিওফেনস থেকে শুরু করে গ্রীক বিভিন্ন ঐতিহাসিকের মতামত উল্লেখ করেছেন যারা মনে করতো মুহাম্মাদ (ﷺ) এপিলেপ্সি আক্রান্ত। এবং এটি প্রচার করা শুরু হয় মহানবী (ﷺ) এর মৃত্যুর ২০০ বছর পর থেকে। [12]Temkin, O., 1994. The falling sickness: a history of epilepsy from the Greeks to the beginnings of modern neurology (Vol. 4). JHU Press. এবং পরবর্তীতে এসব দাবির ভিত্তিতে আমেরিকান নিউরোলজিস্ট ফ্রিমন ১৯৭৬ সালে “A Differential Diagnosis of the Inspirational Spells of Muhammad, the Prophet of Islam” নামে একটি রিসার্চ পেপার প্রকাশ করেন। [13]Freemon F. R. (1976). A differential diagnosis of the inspirational spells of Muhammad the Prophet of Islam. Epilepsia, 17(4), 423–427. https://doi.org/10.1111/j.1528-1157.1976.tb04454.x এই পেপারে তিনি মুহাম্মাদের (ﷺ) ওহী প্রাপ্তির বিভিন্ন ঘটনা মেডিকেল সাইন্সের আলোকে পর্যালোচনা করেন, পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি স্থাপন করেন এবং কনক্লুশন টানেন যে, মুহাম্মাদ(ﷺ) এর সবচেয়ে সম্ভাব্য যে রোগটি হতে পারে তা হলো—টেম্পোরাল লোব এপিলেপ্সি।
রিসেন্টলি ২০২০ এ Epilepsy & Behaviour জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে প্রফেসর হাসান আজিজ মহানবী (ﷺ) র এপিলেপ্সি থাকা না থাকার সম্ভাব্য কারণ গুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি মহানবী (ﷺ) এর জীবনের ১০ টি ঘটনা নিয়ে কাজ করেছেন এবং সেগুলো কে নাম দিয়েছেন Pre Revelation Episodes. তিনি এ ঘটনা গুলোর মেডিকেল ডায়াগনোসিস করেছেন। এবং সেসকল ঘটনাগুলোকে আদৌ এপিলেপ্সির কারণ হিসেবে ধরা যায় কিনা তা নিয়ে আলোচনা করেছেন। এবং তিনি উপসংহারে এসেছেন, ❝ হিস্টোরিক্যাল লিটারেচার এবং হাদিসের ব্যাপক অধ্যায়নের পর এবং peri Revelation Episodes এর স্নায়ুবিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী মহানবী (ﷺ) এর এপিলেপ্সি ছিলোই না। ❞ [14]Aziz H. (2020). Did Prophet Mohammad (PBUH) have epilepsy? A neurological analysis. Epilepsy & behavior : E&B, 103(Pt A), 106654. https://doi.org/10.1016/j.yebeh.2019.106654
সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি, মুহাম্মদ (ﷺ) মিথ্যেবাদী ছিলেন না এবং কোনোরুপ বিভ্রমেও ছিলেন না, সুতরাং তিনি ছিলেন সত্যবাদী এবং যা বলেছেন সবকিছুই সত্য বলেছেন।
উপসংহার:
মানুষের প্রকৃতি অর্থাৎ মানুষ সহজাত ভাবেই ইসলামের উপর জন্মগ্রহণ করে, বুদ্ধিবৃত্তিক বিবেচনায় আমরা আমাদের জগতের একজন স্রষ্টা এবং স্রষ্টার প্রকৃতি সম্পর্কে জানতে পারি এবং আল্লাহই একমাত্র ইলাহ তার প্রমাণ পাই। পরবর্তীতে রাসুলের নবুয়তের সত্যতার সাথে ইসলামের একনিষ্ঠ সত্যতা সম্পর্কে অবগত হতে পারি। মুক্তমনে ইসলাম নিয়ে জানুন এবং সত্যকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করুন। শেষ করছি ইসলামের অন্তর্নিহিত বাণীটি দিয়ে- لَا إِلَٰهَ إِلَّا ٱللَّٰهُ مُحَمَّدٌ رَّسُولُ ٱللَّٰ
আল্লাহ তায়ালাই একমাত্র সত্য ইলাহ, এবং মুহাম্মদ (ﷺ) তাঁর বান্দা এবং প্রেরিত রাসুল “
আল্লাহ আপনাকে সঠিক পথে পরিচালনা করুক এবং আপনার উপর তাঁর অশেষ রহমত নাজিলের মাধ্যমে আপনাকে তাঁর একজন প্রিয় বান্দা হিসেবে কবুল করে নিক।
References
↑1 | The incorrigibility of the cogito”, Johnathan Harrison, Mind: New Series, Vol. 93, No. XCIII, 1984. |
---|---|
↑2 | Roberts, A. J., Wastell, C. A., & Polito, V. (2020). Teleology and the intentions of supernatural agents. Consciousness and cognition, 80, 102905.https://doi.org/10.1016/j.concog.2020.102905 |
↑3 | Loke, A. T. E. (2012). Is an infinite temporal regress of events possible?. Think, 11(31), 105-122.https://doi.org/10.1017/S1477175612000061 |
↑4 | দ্য গড হাইপোথিসিস A case for the existance of Allah, আসিফ মেহেদী, p.78 https://link.boitoi.com.bd/M2N4 |
↑5 | Guth, A. H. (2007). Eternal inflation and its implications. Journal of Physics A: Mathematical and Theoretical, 40(25), 6811https://doi.org/10.1088/1751-8113/40/25/S25 |
↑6 | Branson, B. (2014). The logical problem of the trinity (Doctoral dissertation, University of Notre Dame).https://philarchive.org/archive/BRATLP-3 |
↑7 | Albertz, Rainer (1994). A History of Israelite Religion, Volume I: From the Beginnings to the End of the Monarchy. Westminster John Knox. p. 61. |
↑8 | Noman Daniel, Islam and the west, p.72-77 |
↑9 | Mr.Maim al Humeri, The history of the idea of the Izaz of the Quran, p.27 |
↑10 | সহিহ বুখারী হাদিস ৭ |
↑11 | Lings, M. (1983). Muhammad: His Life Based on the Earliest Sources, p. 34. |
↑12 | Temkin, O., 1994. The falling sickness: a history of epilepsy from the Greeks to the beginnings of modern neurology (Vol. 4). JHU Press. |
↑13 | Freemon F. R. (1976). A differential diagnosis of the inspirational spells of Muhammad the Prophet of Islam. Epilepsia, 17(4), 423–427. https://doi.org/10.1111/j.1528-1157.1976.tb04454.x |
↑14 | Aziz H. (2020). Did Prophet Mohammad (PBUH) have epilepsy? A neurological analysis. Epilepsy & behavior : E&B, 103(Pt A), 106654. https://doi.org/10.1016/j.yebeh.2019.106654 |