মানুষ কিভাবে চিন্তা করে? চিন্তা বা জ্ঞানের উৎস কি মস্তিষ্ক নাকি হৃদয়?

মানুষ কিভাবে চিন্তা করে? চিন্তা বা জ্ঞানের উৎস কি মস্তিষ্ক নাকি হৃদয়?

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’আলা বলেন,

তারা কি যমীনে ভ্রমণ করেনি? তাহলে তাদের হত এমন হৃদয় যা দ্বারা তারা উপলব্ধি করতে পারত এবং এমন কান যা দ্বারা তারা শুনতে পারত। বস্তুত চোখ তো অন্ধ হয় না, বরং অন্ধ হয় বক্ষস্থিত হৃদয়।[1] সূরা আল হজ্জ; ২২ঃ৪৬ 

এতে অবশ্যই উপদেশ রয়েছে তার জন্য যার আছে (বোধশক্তিসম্পন্ন) অন্তর কিংবা যে খুব মন দিয়ে কথা শুনে।[2]সূরা কাফ; ৫০:৩৭ 

পবিত্র কুরআনের এই আয়াত অনুযায়ী মানুষের জ্ঞানের সম্পর্ক বা চিন্তাভাবনা, উপলব্ধির উৎস হলো হৃদয়। তাই নাস্তিক ও অমুসলিমদের প্রশ্ন হলো বিজ্ঞান অনুযায়ী মানুষের জ্ঞান, চিন্তাভাবনা, উপলব্ধির উৎস মানুষের মস্তিষ্ক বা ব্রেইন। কিন্তু কুরআন অনুযায়ী মানুষের চিন্তাভাবনা বা জ্ঞানের উৎস হলো হৃদয়। তাই এই বিষয়ে কুরআনে ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে। (নাউজুবিল্লাহ)

ইসলামিক থিওলজিতে ‘মানুষের চিন্তার উৎস কি মস্তিষ্ক নাকি হৃদয়’ এই বিষয়ে স্কলারদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। কিছু উলামাদের মতে, জ্ঞানের অবস্থানক্ষেত্র মস্তিষ্ক বা মগজ। আবার কেউ কেউ বলেন, উভয় মতের মধ্যে কোন বিরোধ নেই। কারণ কোন কিছুকে জানা ও বোঝার জন্য হৃদয় ও মস্তিষ্কের পারস্পরিক সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর।[3] তাফসীরে আহসানুল বায়ান

শাফিঈ মাযহাব এবং স্কলাস্টিক থিওলজির পণ্ডিতদের মতে, হৃদয় হল ব্যক্তির চিন্তার স্থান অন্যদিকে, ইমাম আবু হানীফাহ (রহ:) মনে করতেন যে, মস্তিষ্ক হচ্ছে মানুষের চিন্তার (Reasoning) স্থান।

ইমাম ইবনে তাইমিয়ার মতে, ‘হৃদয়’ শব্দটি দুটি জিনিসের যেকোন একটিকে বোঝাতে পারে: প্রথমত, পাইন আকৃতির মাংসের পিণ্ড যা মানবদেহের বাম দিকে থাকে এবং এর ভিতরে একটি কালো জমাট থাকে, যেমনটি হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে যে, হৃদয়ের উপর সমগ্র দেহের ন্যায়পরায়ণতা বা কলুষতার নির্ভরশীলতা সম্পর্কে। দ্বিতীয়ত, এটি সাধারণভাবে মানুষের সত্তাকে নির্দেশ করতে পারে, যেমন গম, বাদাম এবং আখরোটকে শস্যের হৃদয় বলা। ফলস্বরূপ, তিনি বলেছিলেন যে যদি ‘হৃদয়’ শব্দটি সাধারণভাবে মানুষের সত্তাকে বোঝায়, তবে এক্ষেত্রে যুক্তি (Reasoning) হৃৎপিণ্ড এবং মস্তিষ্ক উভয়ের সাথেই যুক্ত, কারণ তারা শরীরের অঙ্গ;  আর সেই কারণেই অনেক চিকিৎসকের মতে মস্তিষ্কই হল চিন্তা, জ্ঞান বা Reasoning’এর স্থান।  ইমাম আহমদও একই মত পোষণ করেছেন। ইবনে তাইমিয়া আরো বলেন যে, আত্মা, হৃদয় ও মস্তিষ্ক উভয়ের সাথেই যুক্ত, একইভাবে যুক্তিও (Reasoning) উভয়ের সাথে যুক্ত। একটি ক্রিয়া ঘটবে না যদি না এটি কারো মস্তিষ্কে কল্পনা করা হয় এবং তার হৃদয়ে উদ্দেশ্য করা হয় এবং তাই, উভয়ই এতে অংশগ্রহণ করে। এ থেকে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে কারণ (Reasoning) হৃৎপিণ্ড এবং মস্তিষ্ক উভয়ের সাথেই যুক্ত।[4] The location of reasoning in ones body (islamweb.net)

মানুষের চিন্তার উৎস কি কেবল মস্তিষ্ক?

নাস্তিকদের মতে মানুষের জ্ঞান বা চিন্তার একমাত্র উৎস হলো মস্তিষ্ক। কিন্তু সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা এমনটাই জানিয়েছে যে, ব্যথা সবসময় মস্তিষ্ক দ্বারা তৈরি করা হয়.  এটি সম্পূর্ণ সত্য নাও হতে পারে।  ব্যথা শুধুমাত্র একটি সংবেদনশীল অভিজ্ঞতা নয়, এটি মানসিক, জ্ঞানীয় এবং সামাজিক উপাদানগুলির সাথেও যুক্ত হতে পারে। হৃদয়কে আবেগ, আকাঙ্ক্ষা এবং জ্ঞানের উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয়।…বিজ্ঞানীরা আরো বলেন, হৃদয় শুধু একটি পাম্প নয়। এটির (হৃদয়ের মধ্যে) নিউরাল নেটওয়ার্ক বা “সামান্য মস্তিষ্ক” রয়েছে। হৃৎপিণ্ডকে লক্ষ্য করা পদ্ধতিগুলি মস্তিষ্কের ব্যথা অঞ্চলগুলিকে সংশোধন করে।  এই পদ্ধতিগুলি মস্তিষ্কের অঞ্চলগুলিতে ঘটে যাওয়া মূল পরিবর্তনগুলিকে সংশোধন করে এবং ব্যথার জ্ঞানীয় এবং মানসিক কারণগুলির সাথে জড়িত বলে মনে হয়। এইভাবে, হৃদয় সম্ভবত ব্যথার একটি প্রধান নিয়ন্ত্রক।[5] Pain: Is It All in the Brain or the Heart? | Current Pain and Headache Reports (springer.com)

হার্টম্যাথ ইনস্টিটিউট দ্বারা পরিচালিত গবেষণায় বলা হয়েছে, হৃদয় এবং মস্তিষ্কের মধ্যে যোগাযোগ আসলে একটি গতিশীল, চলমান, দ্বিমুখী সংলাপ, প্রতিটি অঙ্গ ক্রমাগত অন্যের কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করে।  গবেষণায় দেখা গেছে যে, হৃদয় চারটি প্রধান উপায়ে মস্তিষ্কের সাথে যোগাযোগ করে: 

  • স্নায়বিকভাবে (স্নায়ু আবেগের সংক্রমণের মাধ্যমে)
  • জৈব রাসায়নিকভাবে (হরমোন এবং নিউরোট্রান্সমিটারের মাধ্যমে),
  • বায়োফিজিক্যালি (চাপ তরঙ্গের মাধ্যমে)
  • শক্তিশালীভাবে (ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড ইন্টারঅ্যাকশনের মাধ্যমে)।

এই সমস্ত যোগাযোগ মস্তিষ্কের কার্যকলাপকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করে।  তাছাড়া, আমাদের গবেষণা দেখায় যে হৃদয় মস্তিষ্কে যে বার্তা পাঠায় তাও কর্মক্ষমতা প্রভাবিত করতে পারে।[6] Chapter 01: Heart-Brain Communication | HeartMath Institute

হৃদয় আমাদের উপলব্ধি, আবেগ, অভিজ্ঞতা ইত্যাদির উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে। এটির নিজস্ব অভ্যন্তরীণ স্নায়ুতন্ত্র রয়েছে যা মানুষের মস্তিষ্কে প্রচুর পরিমাণ ইনফরমেশন প্রেরণ করে। এবং এই প্রক্রিয়া মানুষের অনুভূতি, চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করে। মস্তিষ্ক হৃদয়ে যে পরিমাণ সংকেত প্রেরণ করে তার চাইতে বেশি সংকেত হৃদয় মস্তিষ্কে প্রেরণ করে। বিজ্ঞানীদের মতে মানুষের হৃদয়ে একটি ছোট মস্তিষ্ক রয়েছে যা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে এবং এর নিউরনের দীর্ঘমেয়াদি এবং স্বপ্লমেয়াদী মেমরি ও ব্যাপক সংবেদনশীল ক্ষমতা রয়েছে।[7] https://youtu.be/WhxjXduD8qw?si=w31kzaoXTIImJJxI সুতরাং, মানুষের চিন্তার উৎস কেবল মস্তিষ্ক এই ধারণাটি বিজ্ঞান সম্মত নয়।

মানুষের হৃদপৃন্ডের ছোট মস্তিষ্ক

কুরআনে যেহেতু মস্তিষ্কের কথা না বলে কেবল হৃদয়ের কথা বলেছে সেহেতু কুরআন অনুযায়ী কি মানুষের জ্ঞান বা চিন্তার উৎস কি কেবল হৃদয়?

কুরআনের যেসব আয়াতে হৃদয় দিয়ে চিন্তা বা উপলব্ধি করার কথা বলা হয়েছে সেসব আয়াতের কোথাও এটা বলা হয়নি যে, মানুষের চিন্তা বা উপলব্ধির একমাত্র উৎসই হলো হৃদয়। সুতরাং, কুরআন অনুযায়ী এটা প্রমাণ হয়না যে চিন্তা বা উপলব্ধির একমাত্র উৎস হলো মানুষের হৃদয়। বরং, কুরআন অনুযায়ী এটাই প্রতিয়মান যে মানুষের চিন্তা বা উৎসের একটি কারণ হলো তার হৃদয়। এই একটি কারণের বাহিরেও যদি মানুষের চিন্তার ক্ষেত্রে শরিরে অন্য কোন অংশের ভূমিকা থাকে তাহলে তা কুরআনের সাথে কোনো প্রকার বৈপরীত্য প্রকাশ করে না। যদি এবং কেবল যদি, কুরআনে মানুষের চিন্তা বা জ্ঞানের একমাত্র উৎস হিসেবে মানুষের হৃদয়ের কথা বলা হতো তবেই বৈপরীত্য প্রকাশ হতো।

বৈজ্ঞানিক কোনো তত্ত্ব কি ঐশীবাণীকে ভুল প্রমাণ করতে পারে?

পর্যবেক্ষণ ,পরিক্ষা নীরিক্ষার মাধ্যমে আমাদের এই মহাবিশ্বের গঠন, এর মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর ব্যাখ্যা প্রদান করাই হলো বিজ্ঞান। অন্যদিকে ঐশীবাণী হলো, স্রষ্টার বাণী। স্রষ্টা এমন এক সত্তা যিনি চূড়ান্ত বাস্তবতা, সর্বশক্তিমান, সবচেয়ে প্রজ্ঞামান, নিখুত সত্তা, এবং তিনি উপসানার যোগ্য। স্রষ্টার প্রজ্ঞা হতে হবে সর্বোচ্চ পর্যায়ের। অর্থাৎ, স্রষ্টা সর্বজ্ঞ বা সব জান্তা। স্রষ্টা সর্বজ্ঞ বলতে বুঝানো হয় যে, তার চাইতে বেশি জ্ঞানের অধিকারী আর কেউ হতে পারে না। তাই স্রষ্টার বাণী সব সময়ের জন্য নির্ভুল ও নিখুঁত।

অন্যদিকে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব প্রদান করে আমাদের মতোই কিছুই মানুষ যাদের জ্ঞান অসীম নয়। বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব প্রদানের অন্যতম একটি শর্ত হলো যে বিষয়ে তত্ত্ব প্রদান করা হয় তা পর্যবেক্ষণযোগ্য হতে হবে। পর্যবেক্ষণ যত বাড়বে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ততই পরিবর্তন হবে। তাই বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব কখনো নিশ্চিত বা নির্ভুল হয় না। বরং, যে কোনো সময়েই বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ভুল প্রমাণিত হতে পারে। যেমন একটা সময় খুবই প্রসিদ্ধ তত্ত্ব ছিলো যে, পৃথিবী স্থির, মহাবিশ্বর কোন সূচনা নেই, ইত্যাদি।  কিন্ত বর্তমান বৈজ্ঞানি তত্ত্ব অনুযায়ী পৃথিবী ঘূর্ণায়মান, মহাবিশ্ব সূচনা রয়েছে (বিগ ব্যাং) ইত্যাদি।

বিজ্ঞান যে পদ্ধতির সাহায্যে তত্ত্ব প্রদান করে তাকে ইন্ডাক্টিভ মেথড বলে। ইন্ডাক্টিভ মেথড হলো বিশেষ বিশেষ দৃষ্টান্তের উপর নির্ভর করে সার্বিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ। মনে করুন, একদল বিজ্ঞানী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে দেখলো যে সেসব দেশের যতগুলো রাজহাস আছে সবগুলোর রং সাদা। তাই তারা সিদ্ধান্ত নিলো পৃথিবীর সকল রাজহাসের রঙ সাদা। 

এখানে বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর সকল দেশ ভ্রমন করে দেখেনি যে আসলেই পৃথিবীর সকল রাজজাস সাদা কি-না? বরং, বিশেষ বিশেষ দেশে ভ্রমণ করেই এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। একইভাবে বিজ্ঞানীরাও বিশেষ বিশেষ দৃষ্টান্তের উপর নির্ভর করেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই পদ্ধতিতে পর্যবেক্ষণ যতই বাড়বে ততই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হবে।

রাজহাসের উদাহরণটির কথাই চিন্তা করুন। একটা সময় আসলেই এমন তত্ত্ব ছিলো যে পৃথিবীর সকল রাজহাসের রঙ সাদা। পরবর্তীতে যখন কালো রাজ হাসের দেখা মিলে তখন এই তত্ত্ব ভুল প্রমাণিত হয়। অর্থাৎ, পর্যবেক্ষণ বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে তত্ত্ব ভুল প্রমাণিত হয়েছে। একইভাবে একটা পর্যবেক্ষণলব্ধ জ্ঞানের সীমার কারণে এমন পৃথিবী নিয়ে এমন তত্ত্ব ছিলো যে, পৃথিবীর স্থির। আবার মহাবিশ্বের উৎপত্তি সংক্রান্ত এমন বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ছিলো যে, মহাবিশ্বের কোন শুরু নেই (অটল মহাবিশ্ব)। কিন্তু পরবর্তীতে পর্যবেক্ষণলব্ধ জ্ঞান বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে আমরা জানতে পারি যে আমাদের পৃথিবী স্থির নয়, মহাবিশ্বের সূচনা রয়েছে বা বিগ ব্যাং এর মাধ্যমে মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে।

সুতরাং, বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব কখনো সুনিশ্চিত বা নিখুঁত কিছু নয়। বরং প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। কিন্তু ঐশীবানী এমন এক সত্তা থেকে আসে যে সত্তার জ্ঞান অসীম। মানুষের যেমন জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা রয়েছে তেমন সীমাবদ্ধতা সেই সত্তার নেই। তাই সসীম সত্তা বা মানুষের সমীম জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে অসীম জ্ঞানের অধিকারী কোন সত্তার বাণীকে ভুল প্রমাণ করতে চাওয়া ক্যাটাগরি মিস্টেক ফ্যালাসির সামিল। তাই বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব কখনোই ঐশীবাণীকে ভুল প্রমাণ করতে পারে ন।

বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানতে পড়ুনঃ [8] https://faith-and-theology.com/বিজ্ঞানের-দর্শন

কুরআন সম্পর্কে অমুসলিমদের অভিযোগ জানতে পড়ুনঃ কুরআন ও হাদিস সংক্রান্ত – Faith and Theology (faith-and-theology.com)

Sazzatul Mowla Shanto

As-salamu alaykum. I'm Sazzatul mowla Shanto. Try to learn and write about theology and philosophy.

One Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button