অধিকাংশ দার্শনিক নাস্তিক হলে কী নাস্তিকতা সত্য হতে বাধ্য?

অধিকাংশ দার্শনিক নাস্তিক হলে কী নাস্তিকতা সত্য হতে বাধ্য?

বঙ্গীয় নাস্তিকরা প্রায় সময় নাস্তিকতাকে যৌক্তিক প্রমাণ করতে একটি কুযুক্তির আশ্রয় নিয়ে থাকে। তাদের দেওয়া কুযুক্তিটি এমন যে, অধিকাংশ দার্শনিক নাস্তিক বা অধিকাংশ দার্শনিকদের নাস্তিকতার পক্ষে ঐক্যমত রয়েছে। সুতরাং, নাস্তিকতা যৌক্তিক। তাদের যুক্তিটি নিন্মরুপ,

P1: যদি নাস্তিক্যবাদের পক্ষে দার্শনিকদের ঐক্যমত্য থাকে বা অধিকাংশ দার্শনিক যদি নাস্তিক হয় তাহলে নাস্তিকতা সত্য।

P2: নাস্তিক্যবাদের পক্ষে অধিকাংশ দার্শনিকদের ঐকমত্য রয়েছে বা অধিকাংশ দার্শনিক নাস্তিক।

C: সুতরাং, নাস্তিকতা সত্য।

এই যুক্তিটির অসারতা বুঝতে হলে আমাদের appeal to popularity fallacy সম্পর্কে জানতে হবে। নাস্তিক্যবাদের পক্ষে দার্শনিক বা যে কারো ঐকমত্য থাকলে, অথবা অধিকাংশ দার্শনিক বা যে কেউই নাস্তিক হলে নাস্তিকতা সত্য হয়ে যাবে, অথবা অধিকাংশ মানুষ কোন কিছুকে সত্য বললে সত্য, মিথ্যা বললে মিথ্যা হয়ে যাবে, এমন দাবি মূলত একটি যৌক্তিক ভ্রান্তি বা কুযুক্তি। যাকে বলা হয় An appeal to popularity fallacy. কোনো কিছুর সত্যতা, বৈধতা, বা যৈক্তিকতার ভিত্তি হিসেবে যদি ন্যায্যতা বা প্রমাণের পরিবর্তে জনপ্রিয়তাকে উপস্থাপন করা হয় তবে এই কুযুক্তিটি ঘটে। উদাহরণস্বরূপ, ধূমপান স্বাস্থ্যসম্মত কারণ অধিকাংশ মানুষ ধূমপান করে।

কিছু নাস্তিক হয়ত বলতে পারে, আমরাতো অধিকাংশ মানুষের সমর্থন নিয়ে নাস্তিকতাকে সত্য দাবি করিনি। বরং, অভিজ্ঞদের মতামতের উপর ভিত্তি করেই আমরা নাস্তিকতা কে সত্য দাবি করি। নাস্তিকরা এমন দাবি করেও নাস্তিক্যবাদকে সত্য প্রমাণ করতে পারবে না। কারণ, অভিজ্ঞদের মতের উপর ভিত্তি করে কোনো দাবিকে সত্য প্রমাণ করাও এক ধরনের কু-যুক্তি, যাকে বলা হয়, Appeal to Authority fallacy.[1] Appeal to Authority (logicallyfallacious.com) কোনো দাবির ন্যায্যতা প্রমাণ করার পরিবর্তে যদি বিশেষজ্ঞদের মতামতের উপর ভিত্তি করে দাবিটির সত্যতা প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয় তবে এই কু-যুক্তি ঘটে। যেমন, মিস্টার করিম একজন অভিজ্ঞ বিজ্ঞানী। তিনি দাবি করলেন পৃথিবী গোলাকার নয়। যেহেতু মিস্টার করিম একজন অভিজ্ঞ এবং তিনি বলেছে পৃথিবী গোলাকার নয়, সেহেতু ‘পৃথিবী গোলাকার নয়’ এই দাবিটি সত্য। এখানে পৃথিবী আসলেই গোলাকার কি-না, তা জানার চেষ্টা না করে একজন অভিজ্ঞ বিজ্ঞানী কি বলেছে তাকেই সত্য হিসবে ধরে নেওয়া হয়েছে। ফলে এখানে কুযুক্তি ঘটেছে। তাই ‘অধিকাংশ দার্শনিক নাস্তিক বা অধিকাংশ দার্শনিকদের নাস্তিকতার পক্ষে ঐক্যমত্য রয়েছে। সুতরাং, নাস্তিকতা যৌক্তিক’ এই দাবিটি মূলত একটি কু-যুক্তি বা অবৈধ।

সত্য শুধু মাত্র কারো দাবি বা বিশ্বাস দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয় না। এর জন্য প্রয়োজন বস্তুনিষ্ঠ তথ্য, প্রমাণ, যৌক্তিক যুক্তি এবং ন্যায্যতা। এগুলো ব্যতীত কোনো কিছু সত্য বলে দাবি করা সত্য হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। এই আলোচনাতে আপনাদের মনে একটি প্রশ্ন জাগতে পারে যে, সত্য আসলে কী? আমি মনে করি সত্য হলো, যা কিছু বাস্তবতার সাথে মিলে যায় তাই সত্য। যেমন, আপনি এই লিখাটি পড়েছেন। এটি একটি সত্য ঘটনা। এই সত্য ঘটনা কখনোই পরিবর্তন হবে না। সমস্ত পৃথবীর মানুষও যদি বলে আপনি লিখাটি পড়েন নি তবুও আপনি যে লিখাটি পড়েছেন তা মিথ্যা হয়ে যায় না। তাই সত্য কখনো পরিবর্তন হয় না। কারো মতামতের উপরও নির্ভর করে না। যা কিছু সত্য তা সব সময়ের জন্যই সত্য। ২+২=৪ এটা সত্য। কখনো যদি সারা দুনিয়ার মানুষ একত্রে বলে ২+২=৫ তাহলে কিন্তু ২+২=৫ সত্য হয়ে যাবে না।

এখন যদি আসলেই অধিকাংশ দার্শনিক দাবি করে যে, নাস্তিকতা সত্য, অথবা অধিকাংশ দার্শনিক যদি নাস্তিকতা গ্রহণ করে, আর তাতেই নাস্তিকতা সত্য হয়ে যায়! তাহলে আজ থেকে ১০০ বছর পর যদি সে সময়ের অধিকাংশ দার্শনিক বলে যে আস্তিকতা সত্য, তাহলে কি তখন আস্তিকতা সত্য হয়ে যাবে? অথবা আজ থেকে কয়েকশত বছর পূর্বে তো নাস্তিকতা বলতেই কিছু ছিল না। তাহলে কি তখন আস্তিকতা সত্য ছিল, আর এখন নাস্তিকতা সত্য? সত্য কি পরিবর্তনশীল? ২+২=৪ এটা কি কোনো কালে গিয়ে ৫ হয়ে যাবে বা কোনো কালে কি ৫ ছিল? আপনি এই বইটি পড়েছেন। কিন্তু কখনো কি এমন হবে যে আপনি বইটি আসলে পড়েন নি? যদি এমন না হয় তবে সত্য আসলে পরিবর্তনশীল নয়।

যদি নাস্তিকদের যুক্তিটি আমাদের মেনে নিতে হয় তাহলে সত্য বলতে আদৌ কিছু আছে কিনা তা নিয়েই প্রশ্ন উঠে! সত্য মেনে নিলেও সত্য হয়ে পরিবর্তনশীল। কিন্তু সত্যের অস্তিত্ব আছে এবং এটা পরিবর্তনশীল নয়। বরং, সত্য সব সময়ের জন্য একই থাকবে। যেমন, একটা বৃত্ত গোলাকার হবে। এটা এখনকার জন্য যেমন সত্য, অতীতেও সত্য ছিল, এবং ভবিষ্যতেও সত্য থাকবে। তাই বিশেষজ্ঞদের ঐক্যমত্যের উপর ভিত্তি করে নাস্তিকরা যে দাবিটি করে থাকে, ‘যেহেতু নাস্তিক্যবাদের নাস্তিক্যবাদের পক্ষে দার্শনিকদের ঐকমত্য থাকে বা অধিকাংশ দার্শনিক যদি নাস্তিক হয় তাহলে নাস্তিকতা সত্য’ এই দাবিটি বৈধ নয়।

অধিকাংশ দার্শনিক কী আসলেই নাস্তিক?

২০১৪ সালের ডেভিড বার্গেট এবং ডেভিড শালমার্স ‘দার্শনিকরা কি বিশ্বাস করেন?’ এই শিরোনামে একটি গবেষণা পত্র প্রকাশ করেন।[2] https://philpapers.org/archive/BOUWDP উক্ত গবেষণায় দর্শনের বিভিন্ন শাখার দার্শনিকগণের সৃষ্টিকর্তার বিশ্বাস এবং আরো অন্যান্য বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়। এই গবেষণার মাধ্যমে তারা জানায়, ধর্মের দর্শন (Philosophy of Religion) ফিল্ডে যারা বিশেষজ্ঞ তাদের মধ্যে ৭৯.১৩ শতাংশ দার্শনিক স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাসী। এবং ২০.৮৭ শতাংশ দার্শনিক স্রষ্টার অস্তিত্বে অবিশ্বাসী। অন্যদিকে, দর্শনের অন্যান্য শাখায় বিশেষজ্ঞ দার্শনিকদের মধ্যে ৮৬.৭৮ শতাংশ দার্শনিক স্রষ্টার অস্তিত্বে অবিশ্বাস করেন। এবং ১৩.২২ শতাংশ দার্শনিক স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন। এই গবেষণা থেকে এটাই প্রতীয়মান যে, একজন দার্শনিক যদি ধর্মের দর্শন বা স্রষ্টার অস্তিত্বের পক্ষের যুক্তিগুলো নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ করে তাহলে তার আস্তিক হওয়ার সম্ভাবনা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। সুতরাং, এই গবেষণার ফলাফল নাস্তিকদের উল্লিখিত যুক্তির বিপক্ষেই কথা বলে।

নাস্তিকদের যুক্তিটির প্রথম প্রেমিস (P1) হলো, যদি নাস্তিক্যবাদের পক্ষে দার্শনিকদের ঐকমত্য থাকে বা অধিকাংশ দার্শনিক যদি নাস্তিক হয় তাহলে নাস্তিকতা সত্য। দ্বিতীয় প্রেমিস (P2) নাস্তিক্যবাদের পক্ষে অধিকাংশ দার্শনিকদের ঐক্যমত রয়েছে বা অধিকাংশ দার্শনিক নাস্তিক।

কোনো দাবির ন্যায্যতা প্রমাণ করার পরিবর্তে যদি অধিকাংশের মতামত বা বিশেষজ্ঞদের মতামতের উপর ভিত্তি করে সে দাবিটির সত্যতা প্রমাণের চেষ্টা করা এক ধরনের কু-যুক্তি। এছাড়াও সত্য কারো মতামতের বা ঐক্যমত্যের উপর নির্ভর করে না। ঐক্যমত্য থাকার পক্ষে যে দাবি তারা করে থাকে তাও সঠিক নয়। তাই নাস্তিকদের যুক্তিটির প্রথম প্রেমিস এবং দ্বিতীয় প্রেমিস বৈধ নয়। যুক্তিবিদ্যার নিয়ম অনুযায়ী প্রেমিস (P) যদি ভুল হয় তবে সিদ্ধান্ত (C) ভুল হতে বাধ্য। তাই নাস্তিকদের যুক্তিটির সিদ্ধান্ত (C) ‘নাস্তিকতা সত্য’ এটিও সত্য নয়।

নাস্তিক্যবাদ নিয়ে অন্যান্য লিখাগুলো পড়ুনঃ https://faith-and-theology.com/নাস্তিক্যবাদ/

Sazzatul Mowla Shanto

As-salamu alaykum. I'm Sazzatul mowla Shanto. Try to learn and write about theology and philosophy.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button