বিজ্ঞান এবং নাস্তিকতা কী সামঞ্জস্যপূর্ণ?

বিজ্ঞান এবং নাস্তিকতা কী সামঞ্জস্যপূর্ণ?

নাস্তিক্যবাদের অনুসারীগণ নাস্তিকতার প্রচার-প্রসারের ক্ষেত্রে মূলত বিজ্ঞানকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। নাস্তিকরা দাবি করে বিজ্ঞান মানুষকে নাস্তিকতার দিকে ঠেলে দেয়। কিন্তু নাস্তিকদের এই ধারণা জন্যই কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। কেননা বিজ্ঞান ও নাস্তিকতা দুটি মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। নাস্তিক হওয়া মানে, আল্লাহ বা স্রষ্টার অস্তিত্বকে পুরোপুরি অস্বীকার করা। দর্শনের ভাষায় এমন মতবাদকে বলা হয়, ‘দার্শনিক প্রকৃতিবাদ’ (Philosophical Naturalism). দার্শনিক প্রকৃতিবাদ অনুযায়ী জগতে ঘটা প্রতিটি ঘটনাকে ভৌতিক প্রক্রিয়ার সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যায়। প্রকৃতির এসব প্রক্রিয়ার পিছনে বিশেষ কোন কারণ বা উদ্দেশ্য নেই। এই দর্শনটি মূলত তিনটি জিনিসের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে। ১. কোনো অতিপ্রাকৃতিক বা ঐশ্বরিক শক্তি নাই। ২. মহাবিশ্বের সব কিছু প্রাকৃতিক বস্তু দ্বারা ব্যাখ্যা করা সম্ভব। ৩. পরকাল বলতে কিছুই নেই।

দার্শনিক প্রকৃতিবাদীরা সব ধরনের অতিপ্রাকৃতিক দাবিকে অস্বীকার করেন। বিখ্যাত নাস্তিক দার্শনিক রিচার্ড ডকিন্স তার লিখিত ‘The God Delusion’ গ্রন্থে দার্শনিক প্রকৃতিবাদ সম্পর্কে বলেন,

দার্শনিক প্রকৃতিবাদ অর্থে নাস্তিক হলো এমন কেউ, যে বিশ্বাস করে প্রকৃতি, ভৌত জগৎ, পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের পিছনে কোনো অতিপ্রাকৃতিক সৃজনশীল বুদ্ধিমান সত্তা লুকিয়ে নেই যিনি চুপিসারে অবস্থান করছেন। কোনো আত্মা নেই যেটা শরীর থেকে বেরিয়ে যায়, নেই কোনো অলৌকিক কিছু। আছে কেবল জাগতিক ঘটনাবলি, যা আমরা এখনো বুঝতে পারিনি।[1] Richard Dawkins, The God Delusion; P-14

এই দার্শনিক প্রকৃতিবাদ বা নাস্তিকতার ভিত্তি হলো অন্ধবিশ্বাস। কারণ, নাস্তিকরা অতিপ্রাকৃতিক সত্তা বা সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব, পরকালের অস্তিত্ব, অবিশ্বাস বা অস্বীকার করে। কিন্তু তারা তাদের এই অবস্থানের পক্ষে সঠিক কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি। নাস্তিক দার্শনিক রিচার্ড ডকিন্স অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির পাবলিক ডায়ালগে স্বীকার করেছেন যে, স্রষ্টা নেই এই ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত নন।[2] Richard Dawkins: I can’t be sure God does not exist – YouTube বিখ্যাত সায়েন্স ফিকশন লেখক ও বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈব রসায়নের অধ্যাপক আইজ্যাক অ্যাসিমভ এক সাক্ষাৎকারে বলেন,

আমি বছরের পর বছর নাস্তিক ছিলাম, কিন্তু কোনো প্রকারে আমি অনুভব করেছি যে, নিজেকে নাস্তিক বলা বুদ্ধিগতভাবে অসম্মানজনক কারণ এটা এমন জ্ঞান অনুমান করে (স্রষ্টার অনস্তিত্ব) যা সে জানেনা।…..আবেগের দিক থেকে আমি নাস্তিক। স্রষ্টা যে নেই, এই ব্যাপারে আমার কাছে কোনো প্রমাণ নেই।[3] Isaac Asimov on Science and the Bible. Isaac Asimov Science and the Bible (sullivan-county.com)

অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির প্রফেসর নাস্তিক পদার্থবিদ লরেন্স ক্রউস বলেন,

আমি প্রমাণ করতে পারবো না যে, স্রষ্টার অস্তিত্ব নেই। কিন্তু আমি এটা (স্রষ্টা) ছাড়া একটা মহাবিশ্বে থাকতে চাই।[4] Lawrence M. Krauss – I can’t prove that God doesn’t exist… (brainyquote.com)

অন্যদিকে, বিজ্ঞান হলো ভৌত জগতের গঠন এবং আচরণের যত্ন সহকারে অধ্যয়ন, বিশেষ করে পর্যবেক্ষণ, পরিমাপ এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে, এবং এই ক্রিয়াকলাপের ফলাফলগুলি বর্ণনা করার জন্য তত্ত্বগুলির বিকাশ।[5] SCIENCE | English meaning – Cambridge Dictionary যাকে দর্শনের ভাষায় বলা হয় পদ্ধতিগত প্রকৃতিবাদ (Methodological Naturalism). মজার বিষয় হচ্ছে, বিজ্ঞানের এই সংজ্ঞা কিন্তু ইউনিভার্সাল কোন সংজ্ঞা নয়। এই একই সংজ্ঞা অনুযায়ী ইতিহাসকেও (History) বিজ্ঞানের বিষয়ে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মতোই ইতিহাসবিদরা জগতে অতীতে কি ঘটেছে তার বুঝার চেষ্টা করে। কিন্তু ইতিহাসকে বিজ্ঞানের বিষয় হিসেবে গণ্য করা হয় না। বিজ্ঞানের সংজ্ঞা নিয়ে দার্শনিকদের মধ্যে বিভিন্ন রকমের মতপার্থক্য রয়েছে। যেমন, ব্রিস্টল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক জেমস লেডিম্যান বলেন,

আমাদের সামনে বিজ্ঞানের অজস্র উদাহরণ থাকলেও বিজ্ঞানকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায় কিংবা কোন ধরনের বিতর্কমূলক কার্যক্রম বা বিশ্বাস কে বৈজ্ঞানিক বলা হবে তা আমরা জানি না![6] James Ladyman; Understanding Philosophy Of Science. Page: 4 

পদ্ধতিগত প্রকৃতিবাদ বা বিজ্ঞান স্রষ্টার অস্তিত্বকে অস্বীকার করে না। বরং, এই মতবাদ স্রষ্টার অস্তিত্ব বা অলৌকিক সত্তা আছে কি না সে সম্পর্কে নীরব থাকে। সুতরাং, দার্শনিক প্রকৃতিবাদ (নাস্তিকতা) আর পদ্ধতিগত প্রকৃতিবাদ (বিজ্ঞান) দুটো আলাদা জিনিস। একটি স্রষ্টার অস্তিত্ব সরাসরি অস্বীকার করে এবং অন্যটি স্রষ্টা আছে নাকি নেই সেই বিষয়ে নীরব থাকে। বিজ্ঞানের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ফিচার, আমেরিকার বিখ্যাত ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্স- বিজ্ঞান কি এই বিষয়ে আলোকপাত করেছেন, বিজ্ঞান প্রাকৃতিক জগৎ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের একটি উপায়। এটা প্রাকৃতিক জগৎ সম্পর্কে জাগতিক ব্যাখ্যা প্রদানে এটি সীমাবদ্ধ। বিজ্ঞান অতিপ্রাকৃতিক বিষয় সম্পর্কে কিছুই বলতে পারেনা। স্রষ্টা আছে নাকি নেই- এই প্রশ্নের জবাবে বিজ্ঞান নিরপেক্ষ”।[7] Teaching About Evolution and the Nature of Science. Page;58

ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত এক গ্রন্থে বিজ্ঞান দার্শনিক গাউচ বলেন,

দুঃখজনক হলেও সত্য, পদ্ধতিগত প্রকৃতিবাদকে মাঝে মধ্যে অস্তিত্বগত প্রকৃতিবাদের (দার্শনিক প্রকৃতিবাদ) সাথে গুলিয়ে ফেলা হয়। তাই কেউ যদি এমন ধারণায় অটল থাকে যে, বিজ্ঞান পদ্ধতিগত প্রকৃতিবাদ মেনে চলে এবং বিজ্ঞান নাস্তিক্যবাদকে সমর্থন করে, তবে তাকে এমন প্রবল উৎসাহ পূর্ণ কথার জন্য বেশি নাম্বার দেওয়া হলেও যুক্তির খাতায় তার নাম্বার হবে কম।[8] Hugh G. Gauch, Scientific Method in brief; P.98 (Cambridge University Press, Sep 6,2012)

বিবর্তনবীদ কার্ল উওস এর মতে,

মানুষ বলে নাস্তিকতা নাকি বিজ্ঞান নির্ভর। একথা আমি পছন্দ করি না। কারণ, বাস্তবতা তা নয়। বরং নাস্তিকতার উপমা হলো-বিজ্ঞানের উপর ভিনগ্রহের প্রাণীদের আক্রমণ করার মতো।[9] Evolution Scientist Carl Woese Dies: The most important Evolution scientist of 20th century.

সুতরাং, অ্যাকাডেমিক অনুধাবন অনুযায়ী বিজ্ঞান কোনো অতিপ্রাকৃতিক সত্তায় বিশ্বাস করে না বা পরকালের অস্তিত্ব বিশ্বাস করে না, এমন কথা মোটেও সত্য নয়। বরং, বিজ্ঞান এসব বিষয়ে নীরব থাকে। অন্যদিকে দার্শনিক প্রকৃতিবাদ অতিপ্রাকৃতিক স্রষ্টার অস্তিত্ব, অতিপ্রাকৃতিক সত্তা, পরকালের অস্তিত্ব, অস্বীকার করে। তাই বিজ্ঞানের সাথে নাস্তিকতার কোনো সম্পর্ক নেই। বিজ্ঞান মানুষকে নাস্তিকতার দিকে ধাবিত করে বা বিজ্ঞান এবং নাস্তিকতা সামাঞ্জাস্যপূর্ণ এমন কথার কোনো যৌক্তিক ভিত্তি নেই। বরং নাস্তিকতার সাথে সম্পর্ক আবেগের, আধ্যাত্মিকতার বা সাইকোলজির।

নাস্তিক্যবাদ বিষয়ক অন্যান্য লিখা পড়ুনঃ https://faith-and-theology.com/নাস্তিক্যবাদ/

References

References
1 Richard Dawkins, The God Delusion; P-14
2 Richard Dawkins: I can’t be sure God does not exist – YouTube
3 Isaac Asimov on Science and the Bible. Isaac Asimov Science and the Bible (sullivan-county.com)
4 Lawrence M. Krauss – I can’t prove that God doesn’t exist… (brainyquote.com)
5 SCIENCE | English meaning – Cambridge Dictionary
6 James Ladyman; Understanding Philosophy Of Science. Page: 4 
7 Teaching About Evolution and the Nature of Science. Page;58
8 Hugh G. Gauch, Scientific Method in brief; P.98 (Cambridge University Press, Sep 6,2012)
9 Evolution Scientist Carl Woese Dies: The most important Evolution scientist of 20th century.

Sazzatul Mowla Shanto

As-salamu alaykum. I'm Sazzatul mowla Shanto. Try to learn and write about theology and philosophy.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button