নাস্তিক্যবাদসকল পোস্টসৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব

স্রষ্টা এবং ব্যক্তিনিরপেক্ষ নৈতিকতা

স্রষ্টা এবং ব্যক্তিনিরপেক্ষ নৈতিকতা 

নৈতিকতা নিয়ে আলোচনা করার আগে আমদের অস্তিত্ব সম্পর্কে একটু আলোচনার প্রয়োজনবোধ করছি। আচ্ছা, আমরা কি অস্তিত্বে আছি? এর উত্তরে পৃথিবীর ৯৯% মানুষ হয়তো বলবে, ‘হুম, আমরা অস্তিত্বে আছি।’ বাকি ১% শতাংশ হয়তো বলবে, ‘না, আমরা আসলে অস্তিত্বে নেই। যেগুলো আমরা বাস্তব মনে করি এগুলো আসলে নিচক স্বপ্নের মায়াজাল ছাড়া আর কিছুই না।’ যদি আমাদের অস্তিত্ব থাকে তাহলে আমাদের নৈতিকতার প্রয়োজন আছে। আর আমাদের যদি অস্তিত্ব না থাকে তাহলে নৈতিকতার প্রয়োজন নেই। যদি আমাদের আসলেই অস্তিত্ব থাকে তাহলে প্রশ্ন আসবে, আমাদের অস্তিত্বের উদ্দেশ্য কি? এই অস্তিত্বের কোন অর্থ আছে, নাকি নিরর্থক ? যদি এই জীবন নিছক কোনো খেলনার পুতুল হয়, যার কোনো উদ্দেশ্য নেই, অর্থ নেই,তাহলে সে জীবনে নৈতিকতারও কোনো প্রয়োজন নেই। আর যদি জীবনের অর্থ থাকে তাহলে নৈতিকতারও প্রয়োজন আছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কোনটা নৈতিক আর কোনটা অনৈতিক তা নির্ধারণ করবো কিভাবে?

নাস্তিকতায় নৈতিকতার অস্তিত্ব নেই।

কর্মব্যাস্ত কোন এক দিন শেষে বাসায় ফিরলেন। ফ্রেস হয়ে আপনার ছোট্ট মেয়ে দিশাকে ডাকলেন। কিন্তু তার কোন সাড়া পাচ্ছেন না। অনেক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর পুলিশ কল করলেন। আপনি খুবই চিন্তিত যে আপনার মেয়েকে হয়তো কেউ অপহরণ করেছে। পুলিশের সাথে আপনি এবং আপনার প্রতিবেশি সহ আপনার মেয়ে দিশাকে খুঁজতে লাগলেন। কয়েকঘন্টা পার হয়ে গেলেও তাকে খুঁজে ফেলেন না। আপনার বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে কয়জন লোক বসবাস করে। তাদের বাসায় গিয়ে খোঁজ করতে দেখা মিললো আপনার কলিজার টুকরো মেয়ে দিশার রক্তাক্ত লাশ। পুলিশ অপরাধীদের জবানবন্দি নিতেই তারা স্বীকার করলো, চকোলেটের লোভ দেখিয়ে আপনার মেয়েকে তারা বাসায় নিয়ে ধর্ষণ করে। তারা খুবই ভয়ে ছিলো যে, দিশা সবকিছু আপনাকে জানিয়ে দিতে পারে এবং আপনি এই ব্যাপারে আইনি পদক্ষেপ নিতে পারেন। তাই তারা ধর্ষণের পর আপনার মেয়ে দিশাকে হত্যা করেছে।

এই গল্পটা বলার কারণ হচ্ছে, এই ধরণের যে কোন ঘটনা আমাদের সবার কাছেই অপরাধমূলক। কিন্তু অন্ত্যন্ত দুঃখের বিষয় এটি যে, বিবর্তনবাদী নাস্তিকদের কাছে এই ঘটনাটি একটা স্বাভাবিক ঘটনা। কিছু মূহুর্তের জন্য চিন্তা করুন, আপনার মেয়ে দিশাকে যারা ধর্ষণ করে হত্যা করেছে তারা কেউ এখন পর্যন্ত বিচারের আওতায় আসেনি। এবং এই অবস্থায় তারা মৃত্যুবরণ করেছে। পৃথিবীতে এমন অসংখ্য ধর্ষক, হত্যাকারী রয়েছে যারা তাদের কৃতকর্মের সাজা না পেয়েই মৃত্যুবরণ করেছে। সুতরাং, যদি স্রষ্টা আসলে নাই থাকে, পরকাল বলতে আসলে কিছু না থাকে তাহলে এই দুনিয়াতে চূড়ান্ত ন্যায় বিচার বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই। ন্যায়বিচার যদি নাই থাকে তাহলে অন্যায় বলেও কোন কিছু থাকেনা। ঠিক যেমন, কোন কিছু কখনোই খারাপ হতে পারেনা যদি ভালো বলতে আসলে কিছু না থাকে। যদি স্রষ্টার অস্তিত্ব না থাকে, তাহলে কোনটা ভালো আর কোনটা খারাপ তা নির্ধারণ করবে ব্যক্তি নিজেই। কারণ স্রষ্টা না থাকলে, ব্যক্তিনিরপেক্ষ নৈতিকতা বলতে কোন কিছু থাকেনা।

বর্তমানে আলোচিত নাস্তিক  রিচার্ড ডকিন্স এক সাক্ষাৎকারে বলেন, 

আমাদের নৈতিকতাবোধ একটি বিবর্তন প্রক্রিয়ার ফলাফল। [1]Frank Turek; Stealing from God Why Atheists Need God to Make Their Case; Chapter-4

সুতরাং নাস্তিক রিচার্ড ডকিন্সের মতে, ধর্ষণ করা খারাপ কিছুনা, এবং এটা নির্ভর করছে আপনার ইচ্ছার উপরে। আপনি যদি মনে করেন ধর্ষণ করা খারাপ তাহলেই ধর্ষণ খারাপ, আপনি যদি মনে করেন ধর্ষণ করা ভালো তাহলে ধর্ষণ ভালো। 

তাছাড়া নাস্তিক্যবাদ অনুযায়ী আমাদের সকল চিন্তা এবং আচরণ হচ্ছে অন্ধকার শক্তির ফলাফল। অর্থাৎ এগুলোতে আমাদের কোন হাত নেই। এগুলো যেভাবে হওয়ার সেভাবেই হচ্ছে। ন্যায়বিচার, নৈতিকতা এবং স্বাধীন ইচ্ছার কোন অস্তিত্ব নেই । নাস্তিক প্রফেসর রিচার্ড ডকিন্স বলেন,

অন্ধশক্তি এবং জেনেটিক প্রতিলিফির এই মহাবিশ্বে কিছু মানুষ আঘাত পাচ্ছে আবার কিছু মানুষ ভাগ্যবান হচ্ছে। এবং এটির কোন ছন্দ বা কারণ নেই, কোন ন্যায়বিচারও নেই।…..ডিএনএ জানে না বা পরোয়া করে না। ডিএনএ শুধু আছে, এবং আমরা তার সঙ্গীতে নাচি। [2]Frank Turek; Stealing from God Why Atheists Need God to Make Their Case; Chapter-4

অর্থাৎ, এই মহাবিশ্বে যা কিছু ঘটে, কেউ আঘাত পাচ্ছে, কেউ দুখ পাচ্ছে এগুলোর কোন কারণ নেই। এগুলো যেভাবে হওয়ার কথা সেভাবেই হচ্ছে। যা কিছু হচ্ছে সবকিছুই ডিএনএ’র কারণেই হচ্ছে। এখানে আমাদের কোন হাত নেই। সুতরাং কোন মানুষ যখন ধর্ষণ করে, হত্যা করে এগুলো তার ডিএনএ’র কারণেই হচ্ছে। তাই নাস্তিক্যবাদ অনুযায়ী আপনার মেয়ে দিশাকে ধর্ষণের পর হত্যা করাটা অন্যায় নয়। এই কাজের জন্য আপনি ধর্ষণকারীদের নিন্দা করতে পারবেন না। কারণ এখানে তার কোন হাত নেই। সে কেবল একটা জৈবিক রোবট যার প্রতিটি কাজ সম্পূর্ণরুপে প্রাকৃতিক কারণ দ্বারা নির্ধারিত। 

সুরতাং, বিবর্তনবাদী নাস্তিকদের মতে আমাদের প্রতিটি কাজ যেহেতু সম্পূর্ণরুপে প্রাকৃতিক কারণ দ্বারা নির্ধারিত এবং ডিএনএ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাই আমরা কোন ব্যক্তির কাজকে নৈতিকভাবে ভুল বলতে পারিনা। কারণ বিবর্তনবাদী নাস্তিকদের কোন ব্যক্তিনিরপেক্ষ নৈতিক ভিত্তি নেই। যার ফলে, তাদের কাছে একজন দানশীল ব্যক্তি যিনি তার সারাজীবনের অর্জিত অর্থ দান করে দিয়েছেন দরিদ্রদের মাঝে এই ঘটনার মতো হিটলারের গণহত্যার বিষয়ও একটা স্বাভাবিক ঘটনা।  

ব্যক্তি নিজেই তার নৈতিকতা নির্ধারণ করবে? 

নাস্তিকরা যেহেতু ব্যক্তিনিরপেক্ষ নৈতিকতাকে স্বীকার করেতে চাইনা, তাই কিছু নাস্তিক মনে করে নৈতিকতা হলো আপেক্ষিক। অর্থাৎ, ব্যক্তি বা সমাজের মানুষই তাদের নৈতিকতা নির্ধারণ করবে। আমেরিকান নাস্তিকদের প্রেসিডেন্ট ডেভিড সিলভারম্যান বলেন, 

ব্যক্তিনিরপেক্ষ নৈতিকতা বলতে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই। নৈতিকতা হলো আপেক্ষিক। [3]Frank Turek; Stealing from God Why Atheists Need God to Make Their Case; Chapter-4

অর্থাৎ, একজন ব্যক্তি নিজেই তার নৈতিকতা নির্ধারণ করবে। কাউকে ধর্ষণ করা, হত্যা এটা নৈতিকভাবে ভালো নাকি খারাপ এটা কেবল ব্যক্তি নিজেই সিদ্ধান্ত নিবে। এক্ষেত্রে আপনি কাউকে ভুল বলতে পারবেন না। কাউকে ধর্ষণ করা আপনার নিকট ভুল মনে হলেও, যে এই কাজটি করেছে তার কাছে কিন্তু এই কাজ ভুল নয়। যেহেতু ভালো এবং খারাপের মানদন্ড হবে ব্যক্তি নিজেই, তাই ব্যক্তির নিকট যা ভালো মনে হবে তাই সে করবে। এমনটা হলে নৈতিকতার কোন অস্তিত্বই থাকেনা। কারণ নৈতিকতা হলো ঐই সকল নীতি যার মাধ্যমে আমরা সঠিক এবং ভুল বা ভাল এবং খারাপ আচরণের মধ্যে পার্থক্য করতে পারি। নৈতিকতা যদি আপেক্ষিক হয় তাহলে ভালো খারাপ বিষয়টাও আপেক্ষিক। একজনের কাছে যেটা ভালো অন্যের কাছে সেটা ভালো নাও হতে পারে। তাই প্রকৃত অর্থে ভালো বা খারাপ বলতে আসলে কিছুর অস্তিত্বই থাকবেনা। নৈতিকতা আপেক্ষিক হলে ধর্ষণ করা, চুরি-ডাকাতি, মানুষ হত্যা এগুলা করা যাবে নাকি যাবেনা এটা কেবল মানুষের একান্ত মতামতের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। এখানে নৈতিক অনৈতিকের কিছু নেই। 

বাংলাদেশে সমকামীতা অবৈধ এবং আইনত দণ্ডনীয় আপরাধ এবং এখানকার মানুষ এটাকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখে। সেকারণে সমকামীরা এখানকার মানুষের কাছে ঘৃণিত ব্যক্তি, তাই এখানকার মানুষ কোন সমকামীর সাথে তাদের সন্তানদের মিশতে দেয়না। এখন নাস্তিক্যবাদ অনুযায়ী কোন নাস্তিক কি বলতে পারবে যে, এদেশের মানুষকে সমকামীতার চর্চা করতে না দেওয়াটা অনৈতিক? এদেশের মানুষ তাদের সন্তানকে সমকামীদের ঘৃণার চোখে দেখে, তাদের সন্তানদের সমকামীদের সাথে মিশতে দেয়না, এই কাজগুলো হলো অনৈতিক। যদি ব্যক্তিনিরপেক্ষ নৈতিকতা বলতে কিছু না থাকে তাহলে কোন মানদন্ডের উপর ভিত্তি করে একজন নাস্তিক এহেন কথা বলবে যে, কাউকে সমকামীতার চর্চা করতে না দেওয়াটা অন্যায় বা সমকামীদের সাথে বাচ্চাদের মিশতে না দেওয়াটা অন্যায়? এই বিষয়টি ভালোমত বুঝার জন্য আমরা একটা কাল্পনিক গল্পের সহযোগিতা নিতে পারে। এই গল্পে আস্তিক চরিত্রে থাকবে মিসবাহ এবং নাস্তিক চরিত্রে থাকবে এলেক্স।

এলেক্সঃ বাংলাদেশের মানুষ সমকামীদের সাথে তাদের শিশুদের মিশতে দেয়না, তারা সমকামীতা চর্চায় মানুষকে বাধা দেয়। এইকাজগুলো অনৈতিক। 

মেসবাহঃ আচ্ছা এলেক্স, আপনি এটা মনে করেন যে, ব্যক্তিনিরপেক্ষ নৈতিকতা বলতে কিছু নেই? 

এলেক্সঃ হুম, ব্যক্তিনিরপেক্ষ নৈতিকতা বলতে কিছু নেই। 

মেসবাহঃ তাহলে আপনি কোন নৈতিক মানদন্ডের উপর ভিত্তী করে বললেন, কেউ যদি সমকামীদের ঘৃণা করে এবং তাদের সন্তাদের  সমকামীতা চর্চা করতে বাধা দেওয়া অন্যায়? আপনি কি আপনার নিজের নৈতিক মানদন্ডের উপর ভিত্তী করে এগুলোকে অনৈতিক বলেন?  

এলেক্সঃ হুম… আমি আমার নৈতিক মানদন্ডের উপর ভিত্তী করেই এই কাজগুলোকে অনৈতিক বলি এবং আমার এই অধিকার আছে।  

মিসবাহঃ কিন্তু একজন ব্যক্তির নৈতিকমানদন্ড আপনার চেয়ে ভিন্ন বলে কি তাকে নিন্দা করতে পারেন? তার কাজকে অনৈতিক বলতে পারেন? যেহেতু নৈতিকতা হলো আপেক্ষিক? আপনার কাছে যেটা নিন্দা তার কাছে সেটা নিন্দা নাও হতে পারে।  

এলেক্সঃ উম….. 

কাল্পনিক গল্প থেকে আমরা শুধুমাত্র এটাই বুঝানোর চেষ্টা করেছি যে যদি আমরা নিজেরাই আমাদের নৈতিকতা নির্ধারণ করি তাহলে কোন ব্যক্তির কাজকে অনৈতিক বলার কোন সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে হয়তো অনেক নাস্তিক বলতে পারে, আমরা আমাদের কাজের জন্য সমাজের নিকট দায়বদ্ধ। তাই আমার কাছে কোন কাজ নৈতিক মনে হলেও সমাজ যদি সেটাকে মেনে না নেয় তাহলে সে কাজ আমরা করতে পারিনা। এক্ষেত্রে আমরা যদি নাস্তিক ব্যক্তির নিকট প্রশ্ন করি, কোন সমাজের নিকট আমরা আমাদের কাজের জন্য দায়বদ্ধ? নাস্তিক ব্যক্তিটির উত্তর এটাই হবে যে, যে সমাজে আমরা বসবাস করি। হতে পারে তার বসবাস করা সমাজের মানুষের কাছে কাউকে হত্যা করা, ধর্ষণ করাটা অন্যায়। যদি কোন সমাজের মানুষের কাছে এগুলো অন্যায় মনে না হয় তাহলে আমরা সেটাকে অনৈতিক বলতে পারিনা। যেমন, হিটলারের সমাজের লোকের কাছে ৬মিলিয়ন ইহুদিকে হত্যা করাটা ছিলো নৈতিক। তাই নাস্তিক্যবাদ অনুযায়ী আপনি কখনোই হিলটারের গণগত্যাকে অনৈতিক বলতে পারেন না। আপনি তখনই হিটলারের কাজকে অনৈতিক বলতে পারবেন যখন নৈতিকতা হবে ব্যক্তিনিরপেক্ষ। অথবা একটা সমাজের মানুষ যদি মনে করে, শিশুদের ধর্ষণ করা নৈতিক, তাহলে নাস্তিক্যবাদ অনুযায়ী আমরা কোনভাবেই এই কাজকে নিন্দা করতে পারিনা। তবুও আমরা যদি এর বিরোধিতা করি, তবে তা হবে কেবল মাত্র আমাদের মতামত এবং আমরা শিশুদের ধর্ষণ করা এবং হিটলারের গণহত্যাকে অনৈতিক হিসেবে নির্ধারণ করতে পারিনা। 

কোন নাস্তিক হয়তো দাবী করতে পারে আমরা যদি গণহত্যা করি, নারীদের ধর্ষণ করি, অন্যায় কাজ করি তাহলে আমরা টিকে থাকতে পারবোনা, রাষ্ট্র আমাদের উপর শাস্তি প্রয়োগ করবে। তাই আমাদের এই কাজগুলো পরিহার করতে হবে। কিন্তু এই দাবীটি সত্য নয়। পৃথিবীর ইতিহাসের দিকে তাকালে এমন অসংখ্য অপরাধীদের পাওয়া যাবে যারা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শাস্তিভোগ করেনি। যেমন নাস্তিক জোসেফ স্টালিন, হিটলার, মাওসেতুং। তারা লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা করেছে। কিন্তু এই দুনিয়ায় তারা বিচারের আওয়াত আসেনি। পৃথিবীর ইতিহাসে তাকালে আমরা এমন হাজারো অত্যাচারি শাসক দেখবো যারা অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা করেছে, অবর্ণনীয় অত্যাচার ও নির্যাতন করেছে। কিন্ত তারা ক্ষমতাবলে এতো মানুষের উপর অন্যায়, নির্যাতন চালিয়েও বেঁচে গিয়েছে। এই ধরণের লোকদের ক্ষেত্রে কি শাস্তি হবে? অথবা কেউ যদি হাজার হাজার লোকদের হত্যা করে নিজে সুইসাইড করে, অথবা কোনো লোক কিছু মানুষকে হত্যা করেছে কিন্তু আদালতে বিচার প্রক্রিয়া শুরুর আগেই মারা গিয়েছে। এই ধরনের লোকের শাস্তি কি হবে? 

দেশে আইন প্রণয়ণ করে কখনো মানুষকে নৈতিক বানানো সম্ভব না। আইন, দন্দডবিধি থাকা সত্ত্বেও সমাজে হত্যা, লুট, রাহাজানি, ব্যভিচার হয়। আইনকে ফাঁকি দিয়েও মানুষ নানারকম রকম অপরাধ করে। টাকার বিনিময়ে আইন কিনে নিয়ে অপরাধী নির্বিঘ্নে মুক্তি পেয়ে যায়। যার ফলে, মজলুম নিপিড়িত মানুষ সুবিচার থেকে বঞ্চিত হয় এবং অপরাধী ব্যক্তিরা আইনকে ফাঁকি দিয়ে বুক ফুলিয়ে সমাজে চলাফেরা করে। 

সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি, নৈতিকতা কখনোই সমাজের মানুষের বোধ-বিবেচনা, চিন্তা-ভাবনা, আবেগ-অনুভূতি থেকে আসতে পারেনা। আসলেও সেটার এপ্লিকেশ্ন পসিবল না। মানব ইতিহাসে এমন কোনো নজির আছে কিনা জানা নেই, যেখানে সমাজের সকল মানুষ একত্রে বসে তাদের নৈতিকতা নির্ধারণ করেছে। তাই নৈতিকতা অবশ্যই ব্যক্তিনিরপেক্ষ হতে হবে। 

আমি বিশ্বাস করি, নাস্তিকদের বিবেক যদি কখনো জাগ্রত হয়, যদি তারা ৬মিলিয়ন মানুষকে হত্যা করা বা শিশুদের ধর্ষণ করাকে বৈধতা দিতে না চাই, তারা যদি এই অবস্থান থেকে ফিরে আসতে চাই যে শিশুদের ধর্ষণ করা বা কাউকে হত্যা করা কেবল মাত্র কারো মতামতের বিষয় না, তবে তারা এমন একটা নৈতিক মানদন্ডের খোঁজ করবে যে নৈতিক মানদন্ড হবে অপরিবর্তনিয়, যেটা আসবে এমন একজন সত্তা থেকে যিনি হবেন সর্বজ্ঞ। যেটাকে আমরা বলি ব্যক্তি নিরপেক্ষ নৈতিকতা। এই ব্যক্তিনিরপেক্ষ নৈতিকতার জন্য স্রষ্টা অনিবার্য। কারণ, নৈতিকতা কোণ অণু দিয়ে তৌরি নয়। নৈতিকরা কোন ওজন নেই। সততার মধ্যে কি পরিমাণ অনু রয়েছে তা কি বলা যায়? এই প্রশ্নগুলো শ্রুতিকটু শুনাচ্ছে। কারণ মোরালিটি কোন অনু গিয়ে গঠিত নয়। ন্যায়বিচারের জন্য একটি অপরিবর্তনীয় ব্যক্তিনিরপেক্ষ নৈতিকতা পেতে, আপনার অণুর প্রয়োজন নেই – আপনার একটি ব্যক্তি নিরপেক্ষ, অপরিবর্তনীয় বিচারক প্রয়োজন যার সর্বোচ্চ অধিকার রয়েছে কর্তৃত্ব দেওয়ার। মানুষ তা দিতে পারে না। মানুষের চিন্তাভাবনা পরিবর্তনশীল এবং এক মানুষ অন্য মানুষের উপর নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব রাখার ক্ষমতা রাখেনা। তাই নৈতিকতার উৎস এমন কোনো সুনিপুণ সত্তা থেকে আসা লাগবে যিনি সর্বোচ্চ জ্ঞানী, এবং সর্বোচ্চ পর্যায়ে ভালো। এর জন্য স্রষ্টার প্রয়োজন। সুতরাং, স্রষ্টার অস্তিত্ব না থাকলে ব্যক্তিনিরপেক্ষ নৈতিকতারও অস্তিত্ব থাকবেনা। স্রষ্টাকে বাদ দিলে নীতি-নৈতিকতাগুলো নেমে যাবে সামাজিক প্রথার স্তরে। অধ্যাপক ইয়ান মার্খাম এর মতে,

আমাদের জীবনের গভীরে লুকিয়ে থাকা রহস্যময় কর্তব্যবোধকে ব্যাখ্যা করেন ঈশ্বর। নৈতিক দাবির সর্বজনীন প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা তিনিই করতে পারেন এবং তিনিই কেবল সর্বজনীন আদেশ দিতে পারেন। কারণ, তিনিই একমাত্র জীবন-জীবিকার উর্ধে। 

[4]দ্যা ডিবাইন রিয়ালিটি, হামজা জর্জিস; পৃষ্ঠা নং; ১৬০

ইসলাম ধর্মে আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া তালার বৈশিষ্ঠ হলো, তিনি সবচেয়ে ক্ষমতাধর, সবচেয়ে ভালো (আল-বার- সকল ভালোর উৎস), সবচেয়ে জ্ঞাণী (আল-হাকিম)। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তালা বলনে,

নিশ্চয় আল্লাহ অশ্লীল কাজের নির্দেশ দেন না। [5]সূরাঃ আল-আরাফ; ৭ঃ২৮

বিজ্ঞান কি ব্যক্তিনিরপেক্ষ নৈতিকতা নির্ধারণ করতে পারে?   

স্রোতের বিপরীতে গা ভাসিয়ে কিছু নাস্তিক আবার ব্যক্তিনিরপেক্ষ নৈতিকতাকে স্বীকার করে নেয়। যেমন, বর্তমানে সবচাইতে জনপ্রিয় নাস্তিকদের একজন হলো স্যাম হ্যারিস। তিনি তার লিখিত একটি দ্যা মোরাল ল্যান্ডস্কেপ বইতে উল্লেখ করেন, 

ব্যক্তিনিরপেক্ষ নৈতিকতা সচেতন প্রণীদের মঙ্গলের সাথে সম্পর্কীত এবং বিজ্ঞান আমাদের সহযোগিতা করতে পারে কি সচেতন প্রাণীদের জন্য মঙ্গল নিয়ে আসে [6]Frank Turek; Stealing from God Why Atheists Need God to Make Their Case; Chapter-4

স্যাম হ্যারিসের এই অবস্থানের সমস্যা হচ্ছে, আমরা কোন পদ্ধতি দিয়ে নৈতিকতা আবিষ্কার করবো তার জন্য তিনি বিজ্ঞানের আশ্রয় নিয়েছে। আর ধার্মিকরা সেখানে ধর্মীয় গ্রন্থের উপর আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু যে পদ্ধতি দিয়েই নৈতিকতা আবিষ্কার করিনা কেন, এতে এটা প্রমাণ হয়না যে নৈতিকতা সেই পদ্ধতি সৃষ্টি করেছে। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে কেন নৈতিকতা বিদ্যমান? বিজ্ঞান নিশ্চয় নৈতিকতা বিদ্যমান হওয়ার কারণ নয়। বিজ্ঞান কোন কিছু সৃষ্টি করতে পারেনা। বিজ্ঞান হচ্ছে একটা টুল যারা সাহায্যে আমরা আমাদের এই মহাবিশ্বের ঘটনাগুলোকে ব্যাখ্যা করতে পারি পর্যবেক্ষণ ও পরিক্ষণের মাধ্যমে। সুতরাং, আমরা যদি এটা মেনেও নি যে  বিজ্ঞান আমাদের নৈতিকতাকে আবিষ্কার করতে সহযোগিতা করতে পারে। কিন্তু বিজ্ঞান কখনোই নৈতিকতা সৃষ্টি করতে পারেনা। 

ধরুণ, একটা ছেলেকে ছুড়ির আঘাতে হত্যা করা হয়েছে। এখানে বিজ্ঞান আমাদের জানাতে পারে, ছুড়ি ছেলেটার শরিরে কত সেন্টিমিন্টার প্রবেশ করেছে, তার শরির থেকে কতখানি রক্তপ্রবাহিত হয়েছে। ছুড়ির আঘাতে তার শরিরের কতখানি অংশ কাটা পড়েছে, ইত্যাদি। কিন্তু বিজ্ঞান কখনোই এটা বলতে পারেনা যে ছেলেটাকে ছুড়ি দিয়ে হত্যা করাটা নৈতিকভাবে সঠিক নাকি ভুল হয়েছে।  তাই প্রশ্ন থেকেই যায়, যদি স্রষ্টা না থাকে কেন নৈতিকতা বিদ্যমান? স্রষ্টার অস্তিত্ব অস্বীকার করে আপনি কখনোই এই প্রশ্নের সুরহা করতে পারবেন না।

এই লিখাটি আমি লিখিছি তা অস্বীকার করে ও লিখাতে আমি কি লিখেছি তা আপনি জানতে পারেন। কিন্ত আপনি যদি বলেন আমার অস্তিত্বই নেই তাহলে এই লিখা সম্পর্কেও আপনি কখনোই জানতে পারতেন না। ঠিক তেমনি, নৈতিকতা স্রষ্টাই দিয়েছে এটা অস্বীকার করেও নাস্তিকরা নৈতিকতা সম্পর্কে জানতে পারে। কিন্তু স্রষ্টাকে অস্বীকার করে তারা নৈতিকতা নির্ধারণ করতে পারেনা। যদি করে তবে তারা স্রষ্টা থেকে সেই নৈতিকতা চুরি করেছে। 

বিবর্তনবাদ দিয়ে কি নৈতিকতাকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব?

ধরুন আমাদের এই দুনিয়ার জীবন একমাত্র জীবন। পরকাল, স্রষ্টা এগুলো সব মানুষের বানানো, এসবের বাস্তব কোনো অস্তিত্ব নেই। সবকিছু বিবর্তনের ফসল। তাহলে এই দুনিয়াতে আমাদের এতো আয়োজন, এতো কার্যাবলি এগুলো আমরা কেন করছি? এর উত্তর হচ্ছে, টিকে থাকার জন্য, নিজেকে ভালো রাখার জন্য। বিবর্তনের ভাষায় যাকে বলে Survival of the fittest. এতোসব আয়োজন যদি নিছকই টিকে থাকার জন্য হয়ে থাকে তাহলে টিকে থাকার তাগিদে যা  কিছুর করার প্রয়োজন তা কিছু করা উচিত আমাদের। এমতবস্থায় আমাদে কাছে ভালো মন্দের ভিত্তি হবে, আমার টিকে থাকার জন্য যা করা দরকার তা ভালো, আর যা আমাকে টিকে থাকতে দিচ্ছেনা সেটা খারাপ। সুতরাং, এই দর্শনে চুরি করা, চিনতাই করা, ধর্ষণ করা এগুলোকে আমরা খারাপ বলতে পারিনা। 

যার পেটে ভাত নেই তার টিকে থাকার জন্য চুরি করা প্রয়োজন। যার টাকা নেই টাকার অভাব মোছন করার জন্য তার চিনতাই করা প্রয়োজন। যৌবিক চাহিদা পূরণ করার জন্য কেউ ধর্ষণও করতে পারে। এগুলো সব টিকে থাকার তাগিদেই করা। আর এ কারণেই হয়তো দার্শনিক ফ্রেড্রিক নিৎসে বলেছেন, 

প্রকৃতি ও প্রাণিজগতে নিরন্তন আত্মরক্ষা ও বাঁচার সংগ্রাম চলছে। এই বাঁচার সংগ্রামের পরিমাণ হচ্ছে- ক্ষমতা বিস্তারের অদম্য ইচ্ছা। তাই শোষক, শোষিত বা দাস, প্রভু এগুলো প্রকৃতগত ব্যাপার। শোষণ করা প্রত্যেক জীবরেই চরিত্রগত বৈশিষ্ঠ আর দাস হওয়াটাও বাঁচার সংগ্রামে পরাজিত পক্ষের অনিবার্য ভাগ্য। পরাজিত পক্ষের দাসত্ব বরণ করা হলো- বাস্তব সত্যের স্বীকৃতি। 

[7]মুক্তচিন্তা ও ইসলাম; মুজাজ্জাজ নাঈম, পৃষ্ঠা নং-৯৬

আরেকটু চিন্তা করে দেখুন, এই দুনিয়ার জীবনই যদি একমাত্র জীবন হয়, মরার পরে সবাই পচে-গলে যাবো, কোনো জবাবদিহিতা নেই মৃত্যুর পর- যদি আসলেই এমন হয়, তো আমি কেন অন্যের সম্পত্তি লুট করে বড়লোক হবোনা? মানুষতো সুখবাদী! আমি কেন সুখ থেকে বঞ্চিত হবো? এই জীবনকে যদি একটা সরল রেখার সাথে তুলনা করি- এই সরল রেখার সামনে যদি কেবলই শূণ্যতাই অপেক্ষা করে তাহলে কেন আমি এই জীবনে নিজের অর্থ সম্পদ বিলিয়ে অন্যকে খুশি করবো? কেন আমি এই জীবনকে উপভোগ করবোনা? কেন আমি ক্ষমতাবান হয়ে সবার সম্পত্তি লুটতরাজ করবোনা? বিববর্তনবাদী দর্শনে এই প্রশ্নগুলোর কোন উত্তর নেই। বরং এই দর্শন আমাদের শিখিয়ে যায়, বিবর্তনবাদ আমাদের শিখায়, শক্তিমানেরা টিকে থাকবে, দূর্বলরা পরাজিত হবে। তাই এখানে নৈতিক অনৈতিক বলে কিছু নেই। নাস্তিক রিচার্ড ডকিন্স ও স্যাম হ্যারিস হয়তো এই কারণে নৈতিকতার ক্ষেত্রে ডারউইনিজমের বিপক্ষে অবস্থান করে। ডকিন্স ABC Radio National এর একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন,

অতীতে বিবর্তনের উপর নৈতিকতার ভিত্তি করার চেষ্টা করেছে। আমি এমনটা করতে চাইনা। একজন ডারউনিয়ানের নিকট যে ধরণের বিশ্ব তা “survival of the fittest (যোগ্যতমের বেঁচে থাকা)” এর দিকে ফিরে যাচ্ছে এবং প্রকৃতি এখন দাঁত ও নখের আঘাতে রক্তে রঞ্জিত। ……..ডারউইনবাদের উপর ভিত্তি করে যে রাজনীতি তা আমার জন্য খারাপ রাজনীতি হবে, তা হবে অনৈতিক। এটিকে অন্যভাবে বললে, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আমি একজন অনুরাগী ডারউইনিয়ান, যখন এটি বিশ্বকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে আসে, তবে নৈতিকতা এবং রাজনীতির ক্ষেত্রে আমি একজন উত্সাহী ডারউইনবিরোধী। [8]The Descent of Man – The Moral Animal (full transcript) (abc.net.au)

বিবর্তন প্রক্রিয়া যেহেতু একটি পরিবর্তনশীল প্রক্রিয়া সেহেতু যদি বিবর্তন প্রক্রিয়ার সাহায্যে আমরা নৈতিকতা নির্ধারণ করতে যায় বা নৈতিকতা নির্ধারক হিসবে যদি বিবর্তন প্রক্রিয়ার সাহায্য নিয়ে থাকি তাহলে নৈতিকতা হবে পরিবর্তনশীল। তাই কোন একটা সময় ধর্ণষ করা, হত্যা করা ভালো বলে বিবেচিত হতে পারে। তাই বিবর্তন প্রক্রিয়ায় নৈতিকতা অপরিবর্তনীয় এবং ব্যক্তি নিরপেক্ষ হওয়া সম্ভব নয়।   

নৈতিকতা এবং বায়োলজি পুরোপুরি আলাদা ক্যাটাগরি। তাই কেউ যদি এই দুটোকে গুলিয়ে ফেলে অর্থাৎ নৈতিকতাকে বায়োলজি বা বিবর্তন প্রক্রিয়ার সাহায্যে বাখ্যা করার চেষ্টা করে তাহলে অবশ্যই ক্যাটাগরি মিস্টেক ফ্যালাসি ঘটবে। ক্যাটাগরি মিস্টেক ফ্যালাসি বলতে বুঝানো হয়, কোন একটা বিভাগের অন্তগর্ত কিছুকে যদি অন্য বিভাগের মনে করা বা অন্য বিভাগের সাহায্যে ব্যাখা করতে চাওয়া।

যারা নৈতিকতাকে জীববিজ্ঞানের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করতে চাই তাদের কাছে আমাদের প্রশ্ন থাকবে, নৈতিকতার রাসায়নিক গঠন কেমন? নৈতিকতার স্বাদ কেমন? নৈতিকতার গন্ধ কেমন? এগুলোর কোনোটিই নৈতিকতার মধ্যে নেই। সুতরাং, নৈতিকতাকে যদি বিবর্তনবাদ বা জীব বিজ্ঞানের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা হয় তাহলে অবশ্যই ক্যাটাগরি মিস্টেক ফ্যালাসি ঘটবে। নৈতিকতা এবং জীববিজ্ঞান আলাদা বিভাগের। আপনি কখনোই অবস্তুগত নৈতিকতাকে বস্তুগত জৌবিক প্রক্রিয়া দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারবেন না। জেনেটিক কোডের কি এই কর্তৃত্ব থাকতে পারে যে আপনাকে বলে দিবে আপনার কি করা উচিত? অবশ্যই পারেনা। 

তবুও যদি আমরা কিছু সময়ের জন্য তর্কের খাতিরে ধরে নেয় যে, জীববিজ্ঞান দিয়ে নৈতিকতাকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব তাহলে ব্যাক্তিনিরপেক্ষ ভালো-খারাপ বলতে আর কোন কিছুর অস্তিত্ব থাকেনা।  যদি আমাদের নৈতিক আচরণ বিবর্তন প্রক্রিয়া বা জীববিজ্ঞানের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয় তাহলে আমাদের আচরণের উপর আমাদের কোন হাত থাকেনা। সব কিছুই প্রাকৃতিক কারণে হয়। একটা ধর্ষক যখন ধর্ষণ করে তা যেমন প্রাকৃতিক কারণে হয় তেমনি একজন দানশীল যখন দান করে সেটাও প্রাকৃতিক কারণে হয়। যেহেতু আচরণের উপর ব্যক্তির কোন নিয়ন্ত্রণ থাকেনা তাই কোন কাজের জন্য আমরা ব্যক্তিকে ক্রেডিট বা ডিসক্রেডিট দিতে পারিনা। তাই নৈতিকতা যদি বিবর্তন প্রক্রিয়া বা জীববিজ্ঞানের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রীত হয় তাহলে ভালো-খারাপ বলতে কোন কিছুই এক্সিস্ট করেনা। সবকিছুই প্রাকৃতিক নির্বাচন।

ইউথিফ্রোর উভয় সংকট

নাস্তিক্যবাদের অনুসারিগণ ব্যক্তিনিরপেক্ষ নৈতিকতা স্রষ্টা থেকে আসতে হবে এমন দাবীকে খন্ডন করতে একটি আপত্তি তুলে থাকেন। তাদের মতে, স্রষ্টার মধ্যেও ব্যক্তিনিরপেক্ষ নৈতিকতা স্থাপন করা যায়না। কারণ হিসেবে তারা ইউথিফ্রো উভয় সংকট দেখানোর চেষ্টা করে। ইউথিফ্রো সংকটটি এমন যে, স্রষ্টা আদেশ করেছেন বলেই কি কোন কিছু ভালো নাকি কোন কিছু নৈতিক বলেই স্রষ্টা আদেশ করেছে? 

নৈতিকতা যদি আল্লাহর আদেশের উপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হয় তাহলে, কোনটা ভালো আর কোনটা খারাপ তা একনায়কসুলভ বা সেচ্ছাচারি সিদ্ধান্ত হবে। অন্যদিকে কোন কাজ নৈতিক বলেই যদি স্রষ্টা সেগুলোকে নৈতিক বলেন তাহলে  অর্থাৎ, স্রষ্টা নিজেই নৈতিক নিয়মের মধ্যে আবদ্ধ। যদি তাই হয় তাহলে স্রষ্টাকে আর কোনোভাবেই সবচেয়ে শক্তিমান বলা যাবেনা। 

তবে এই আপত্তিকে মোটেও ইউথিফ্রোর সংকট বলা যায়না। ইউথিফ্রোর সংকটে শুধুমাত্র দুটি বিপরীত বিকল্প রয়েছে। যেমন, A বা -A। কিন্তু নাস্তিকরা এখানে আগে থেকেই ধরে নিচ্ছে যে, স্রষ্টা আদেশ করেছেন বলেই কোন কিছু নৈতিক হবে অথবা নৈতিক বলেই স্রষ্টা আদেশ করেছেন। কিন্তু এখানে তৃতীয়  আরো একটা বিকল্প থাকতে পারে। স্রষ্টা যেহেতু সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ, স্ব-নির্ভর সেহেতু নৈতিক মানদন্ডের জন্য স্রষ্টাকে অন্য কিছুর উপর নির্ভরশীল হতে হয়না। যদি অন্য কোন মানদন্ডের উপর নির্ভর করতে হয় তাহলে তিনি স্রষ্টা হবেন না। এছাড়া, স্রষ্টা সেচ্ছাচারী নন।

যাইহোক, আমাদের তৃতীয় বিকল্প হল স্রষ্টা স্বভাবগতভাবে নৈতিক। ন্যায়পরায়ণতার মান যাকে আমরা নৈতিক আইন বলে জানি তা স্বয়ং স্রষ্টার প্রকৃতি থেকে প্রবাহিত হয়।

ইসলামী বিশ্বাস অনুযায়ী, আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া তায়ালা অনিবার্যভাবে এবং নিখুঁতভাবে কল্যাণময়। আল্লাহর প্রকৃতিই হচ্ছে নিখুঁত যৌক্তিক নৈতিক মানদন্ড। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বলেন,

নিশ্চয় আল্লাহ অশ্লীল কাজের নির্দেশ দেন না। [9]সূরাঃ আল-আরাফ; ৭ঃ২৮

সুতরাং, কোনো কাজ এই কারণে খারাপ নয় যে, তা সকল মানুষেড় কাছে খারাপ মনে হচ্ছে। অথবা, কোনো কাজ সকল মানুষের কাছে ভালো মনে হচ্ছে বলেই সেটা ভালো নয়। বরং স্রষ্টা নির্ধারিত ব্যক্তিনিরপেক্ষ নৈতিক মানদন্ডের কারণেই কোন কাজকে আমরা ভালো বা খারাপ বলতে পারি। স্রষ্টা এই নৈতিক মানদন্ডের অধীন নন। কারণ, নৈতিক হওয়াটা স্রষ্টার সত্তার মধ্যেই রয়েছে।

আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও নৈতিক চরিত্র গঠন 

স্রষ্টার অস্তিত্ব ব্যতিত ব্যক্তিনিরপেক্ষ নৈতিকতা থাকা পসিবল নয়। অন্যদিকে, ব্যক্তি নিজেই নিজের নৈতিকতা নির্ধারণ করবে এটিও স্ব-বিরোধী মতবাদ। তাই ব্যক্তি নিরপেক্ষ নৈতিকতা এবং স্রষ্টার অস্তিত্ব থাকা আবশ্যক। স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাস ছাড়া যে মানুষ নৈতিক হতে পারবেনা বিষয়টা এমন নয়। উপরে আমরা দেখেছি যদি স্রষ্টা না থাকে, মানুষ যদি কেবল বিবর্তনের ফসল হয় তাহলে বোকা মানুষ ছাড়া কেউ নৈতিক হবেনা। যদি পরকাল না থাকে, যদি এই দুনিয়ার জীবনই একমাত্র জীবন হয়, কোনো প্রকার জবাবদিহিতা না থাকে তাহলে কেন আমি অন্যের উপকার করবো? কেন আমি অন্যের ক্ষতি করে নিজে সুখে থাকবোনা? 

একজন নৈতিক মানুষ হতে গেলে আমাদের প্রথমে অপরাধ ধমণ করার চাইতে অপরাধের মূলোৎপাঠনই কাম্য হওয়া উচিত। মানুষের ভেতরে সর্বপ্রথম অপরাধের প্রবণতা জন্মলাভ করে তার মনের গহীণ কোণে। আশপাশের কুরুচিপূর্ণ পরিবেশ, পাপাচারীদের সাহচার্য, অশ্লীল নাটক-সিনেমা, লোভ-লালসা, হিংসা ইত্যাদি মানুষের নৈতিকতা ধ্বংসের সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তাই আমাদের উচিত মনের মধ্যেই এই প্রবণতাগুলোর অংকুরে বিনিষ্ট করে দেওয়া। তার জন্য প্রয়োজন খোদাভীতি, পরকালের বিশ্বাস। মানুষের অন্তরে যদি দৃঢ় বিশ্বাস থাকে যে দুনিয়ার জীবনই একমাত্র জীবন নয়, মৃত্যুর পরেও আরেকটা জীবন অপেক্ষা করছে আমার জন্য, দুনিয়ার কর্মকান্ডের হিসেব সেখানে দেওয়া লাগবে এবং চাইলেও সেই বিচার ব্যাবস্থাকে ফাঁকি দেওয়া সম্ভবনা- এহেন বিশ্বাস মানুষকে সকল প্রকার অনৈতিক কাজ থেক দূরে রাখতে পারে। এই ব্যাপারে একটা দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করছি, 

খলিফা হযরত উমর (রাঃ) এর শাসনামলে মদীনার উপকন্ঠে এক মহিলা ও তার মেয়ে বসবাস করতো। একদিন রাতে মহিলা দুধে কিছু পানি মিশিয়ে দেয়, বেশি দাম পাওয়ার জন্য। এটা দেখে মেয়েটা তার মাকে বললো- খলিফা দূর্নীতিকারীদের জন্য শাস্তি ঘোষণা করেছেন! 

জবাবে মহিলাটি বললো, রাত্রীবেলায় কেউ দেখবেনা। 

মেয়েটা বললো- তারা আমাদের দুষ্কর্ম না দেখতে পারে, কিন্তু আল্লাহর চক্ষুকে কি তুমি ফাঁকি দিতে পারবে? কিয়ামতের মাঠে আমরা ধরা পড়ে যাবো। এ কথা শুনে মহিলা তার নিজের ভুল বুঝতে পারে। [10]মৃত্যু যবনিকার ওপারে; আব্বাস আলী খান, পৃষ্ঠা নং;২৯-৩০

এই দৃষ্টান্তের মধ্যেও দেখুন, যতক্ষণ স্রষ্টার ভয় ছিলোনা ততক্ষণ মহিলাটি অপরাধ করার জন্য একটুও অনুতপ্ত ছিলোনা, বরং রাষ্ট্রীয় আইন ফাঁকি দিয়ে অপরাধ করার চেষ্টা করেছিলো। একমাত্র আল্লাহর ভয়ই তাকে অপরাধের পথ থেকে ফিরিয়ে এনেছে। 

References

References
1, 2, 3, 6 Frank Turek; Stealing from God Why Atheists Need God to Make Their Case; Chapter-4
4 দ্যা ডিবাইন রিয়ালিটি, হামজা জর্জিস; পৃষ্ঠা নং; ১৬০
5, 9 সূরাঃ আল-আরাফ; ৭ঃ২৮
7 মুক্তচিন্তা ও ইসলাম; মুজাজ্জাজ নাঈম, পৃষ্ঠা নং-৯৬
8 The Descent of Man – The Moral Animal (full transcript) (abc.net.au)
10 মৃত্যু যবনিকার ওপারে; আব্বাস আলী খান, পৃষ্ঠা নং;২৯-৩০

Sazzatulmowla Shanto

As-salamu alaykum. I'm Sazzatul mowla Shanto. Try to learn and write about theology and philosophy.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button